ছবি: সংগৃহীত
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের ৮৩ বছরের বৃদ্ধ মো. হোসেন আহম্মদ। নিজের জমিতে ইঁদুরের উৎপাত দেখে ২০ বছর বয়স থেকে শুরু করেন ইঁদুর নিধন। সেই থেকে ইঁদুর নিধনই তার নেশা। ৬০ বছর ধরে করছেন এই কাজ। পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ফাঁদ পেতে ইঁদুর ধরে তিনি পেয়েছেন অর্ধশতাধিক পুরস্কার।
উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, প্রতিবছর অক্টোবর থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মাসব্যাপী ফসল রক্ষায় ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালিত হয়। এতে উপজেলা, জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায় থেকে দেশ সেরা ইঁদুর শিকারিদের পুরস্কৃত করা হয়। হোসেন আহম্মদ চলতি বছর ১২ হাজার ৫৮৯টি ইঁদুর মেরে জেলা ও উপজেলায় প্রথম এবং চট্টগ্রাম বিভাগে দ্বিতীয় হয়েছেন। এভাবে বিগত ৬০ বছর ধরে তিনি প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ ইঁদুর মেরেছেন। এলাকায় মূল নামের চেয়ে ইঁদুর ধরায় মানুষের দেয়া বিভিন্ন নামেই বেশি পরিচিত হোসেন আহম্মদ।
হোসেন আহম্মদ ইঁদুর নিধনে ব্যবহার করেন পরিবেশবান্ধব নিজস্ব কৌশল। নিজের কৌশলের কথা উল্লেখ করে হোসেন আহম্মদ বলেন, প্রথমে বাঁশের কঞ্চি ও তার দিয়ে ফাঁদ তৈরি করি। ফাঁদে টোপ হিসেবে ধান, গম, ডাল আবার অনেক সময় শামুক ও নারকেল ব্যবহার করি। এসব খেতে এসে ইঁদুর ফাঁদে আটকা পড়ে। পরে বাঁশের ভেতর থেকে বের করে বস্তায় ভরে ওই ইঁদুর মেরে ফেলি। আর খাঁচা বসিয়ে যেগুলো ধরি সেগুলো পানিতে চুবিয়ে মেরে ফেলি। এভাবে ৬০ বছর ধরে এ কাজ করে আসছি। এটা এখন আমার কাছে নেশার মতোই।
হোসেন আহম্মদ ইঁদুর নিধনে পুরস্কার পেতে শুরুর দিকে সংশ্লিষ্ট দফতরে ইঁদুরের লেজ জমা দিলেও এখন আর দেন না। নিজের শুরুর পথচলার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সাত-আট বছর বয়স থেকে ইঁদুর মেরে আসছি। এরশাদের আমল থেকে ইঁদুর নিধনে নিয়মিত পুরস্কার পাচ্ছি। তখন লেজ জমা দিয়ে ১২০ কেজি করে দুবার গম পেয়েছিলাম। তবে এখন আর লেজ জমা দেয়া হয় না। তারপর থেকে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছি।
বর্তমানে তার ইঁদুর নিধনের বিষয়টি পুরো উপজেলায় আলোচিত। আর এজন্য আশপাশের এলাকায় ইঁদুরের উপদ্রব বন্ধে ও ইঁদুর নিধনের জন্য ডাক পড়ে হোসেনের। তবে এজন্য কোনো বিনিময় বা টাকা নেন না তিনি।
হোসেন আহম্মদ বলেন, অনেকে ইঁদুর নিধনের বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে নেয় না। তখন আমি ইঁদুরের ক্ষতিকর দিকগুলো বুঝিয়ে বলি। কারো প্রয়োজন হলে আমার জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে ফাঁদ পেতে ইঁদুর ধরি। তবে বিনিময়ে কোনো টাকা-পয়সা গ্রহণ করি না। অনেকে খুশি হয়ে মাঝেমাঝে চা-নাস্তা খাওয়ায়। যেখান থেকে ডাক আসে সেখানে গিয়ে ইঁদুর ধরি। আবার তাদের ইঁদুর নিধন পদ্ধতিও শিখিয়ে দিয়ে আসি।
বৃদ্ধ হোসেন আহম্মদ কৃষক ও কৃষির সমৃদ্ধির জন্য কাজ করে গেলেও এখনো তার ভাগ্য বদলায়নি। তিনি বলেন, আমি সারাজীবন দেশ এবং দেশের কৃষির জন্য খাটছি। কখনো বিনিময় নিয়ে কাজ করিনি। মানুষ ডাক দিলে সবসময় তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করি। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে আজও তেমন কিছুই পাইনি। বর্তমানে আমার অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ।
আরও পড়ুন <> ইদুঁর নিধনে কৃষকের বন্ধু জাকির
আবু ইউছুপ নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, এলাকার বৃদ্ধ হোসেন আহম্মদ দীর্ঘদিন ধরে ইঁদুর নিধনে কাজ করছেন। এতে এলাকার ফসল ও কৃষকের অনেক উপকার হচ্ছে। এ কাজের জন্য এখন পুরো সোনাগাজী উপজেলার মানুষ তাকে লেজওয়ালা দাদা নামেই চেনে।
মো. আলাউদ্দিন নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষই কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। তিনি ইঁদুর নিধনের মাধ্যমে গ্রামবাসীর এবং ফসলের অনেক উপকার করছে। আমাদের প্রয়োজনে যখনই উনাকে ডাকি সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেন। এলাকায় এখন তিনি ইঁদুর মামা, লেজওয়ালা দাদা-চাচা নামেই বেশি পরিচিত।
হাজী সাহাব উদ্দিন নামে স্থানীয় এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, তিনি নিজে কাজ করার পাশাপাশি আমাদের এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। এ কাজের জন্য তিনি কখনো টাকা নেননি। বরং অনেক সময় আমাদের ইঁদুর ধরার বিভিন্ন সরঞ্জাম দেন।
মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নে দায়িত্বরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আজিজ উল্যাহ বলেন, ইঁদুর নিধনের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে এলাকাবাসী ও পরিবারের সদস্যদের উপহাসের পাত্র হয়ে গেছেন তিনি। আমরা কাজের মূল্যায়ন করতে জানি না। যে লোকটি ইঁদুর মারার মাধ্যমে সবার উপকার করে যাচ্ছেন, অনেকেই তাকে নানা ব্যঙ্গাত্মক নাম দিয়ে ডাকেন।
সোনাগাজী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. আল আমিন বলেন, ইঁদুর প্রতিবছরই দেশে ৫০ থেকে ৫৪ লাখ মানুষের খাবার নষ্ট করে। সারাদেশের মতো সোনাগাজীতেও আমরা সারাবছর ইঁদুর নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমরা প্রায় ৮৩ হাজার ইঁদুর নিধন করতে সক্ষম হয়েছি। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ইঁদুর নিধনে ব্লক ভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপ কাজ করে। তারই ধারাবাহিকতায় সোনাগাজীর কৃষক হোসেন আহম্মদ এ অর্থবছরে একাই ১০ হাজার ইঁদুর নিধন করেছেন। উপজেলায় তার মতো মানুষ গড়তে কাজ করছি, যারা আগামীতে মানুষের ফসলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।
ইঁদুর নিধনে জড়িতদের সঙ্গে সামাজিক আচরণ ও কৃষি বিভাগের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, আমাদের আশপাশেই ইঁদুর বসবাস করছে। কিন্তু অনেকেই এটির ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানি না। একজোড়া ইঁদুরের বছরে ১৫শ থেকে দুই হাজার প্রজনন ক্ষমতা রাখে। আর্থিকভাবে ইঁদুরের ধারা ক্ষতির সম্মুখীন হলেও সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই। মূলত এই জ্ঞান না থাকার কারণে ইঁদুর নিধনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আমরা বিভিন্নভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি। আর এজন্যই হোসেনের মতো এধরনের কৃষকদের কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সবসময় পরামর্শ দেয়া হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়। এতে তারা নিজেদের সম্মানিত বোধ করেন।
আপন দেশ/আরএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।