ছবি : সংগৃহীত
সিরাজগঞ্জের তাড়াশে প্রায় ৩০০ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে আগামী বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) বসছে দইমেলা।
শত শত বছর ধরে এ দইমেলায় এলাকার নামকরা ঘোষদের দইয়ের পাশাপাশি বিক্রি হয় আমন, আউশ, বিন্নি ধানের মুড়ি, মুড়কি, চিড়া, পাটালি গুড়, কদমা, বাতাসা, খই, চিড়া, মুড়ির মোয়া প্রভৃতি।
সেই সঙ্গে থাকবে শিশুদের নানা রঙের বাহারি মাটির খেলনা। অনেকে মেলা থেকে দই কিনে বাড়িতে ফিরবেন। এ এলাকার এখনও এমন পরিবার আছে, যারা বছরের ওই একটি দিনেই এ দইমেলা থেকে দই কিনে খাবেন। ঐতিহ্যবাহী দইমেলার দিন দই কেনেন না এমন পরিবার পাওয়া কঠিন।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, আগে তাড়াশের দইমেলা জৌলুসপূর্ণ ছিল। এ দইমেলার আগেই এলাকার গৃহস্থ বাড়িতে জামাই-ঝিদের নাইয়োরে আনার রেওয়াজও ছিল। জমিদার আমল ও পরের কিছু সময় তাড়াশের ঐতিহ্যবাহী দইমেলা তিন দিনব্যাপী উৎসব আমেজে অনুষ্ঠিত হতো। এখনও রেওয়াজ মেনে মাঝারি আকারে প্রতি বছরই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তবে তা কমে এসেছে একদিনে।
তৎকালীন সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় দূর-দূরান্তের দই তৈরিকারক ব্যবসায়ী ঘোষরা আগেভাগেই দইমেলার স্থানে আসতেন। জমিয়ে মেলায় বেচাকেনাও করতেন তিন দিনব্যাপী। এভাবে এখনও এলাকার মানুষ বছরে প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী দইমেলার ওই দিনটির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। দই অনেকের কাছে এটি অপেক্ষার একটি দিন।
ঠিক সন-তারিখ বলা না গেলেও, জমিদার আমলে তাড়াশের ঐতিহ্যবাহী দইমেলা শুরু হয়েছিল– এটি সবারই জানা। কথিত আছে, তাড়াশের তৎকালীন জমিদার বনোয়ারী লাল রায় বাহাদুর প্রথম দইমেলার প্রচলন করেছিলেন। সাধারণত জনশ্রুতি এমন, জমিদার রাজা রায় বাহাদুর দই ও মিষ্টান্ন খেতে খুব পছন্দ করতেন।
এ ছাড়া জমিদার বাড়িতে আসা অতিথিদের আপ্যায়নে এ অঞ্চলে ঘোষদের তৈরি দই পরিবেশন করার রেওয়াজ ছিল। সে থেকেই জমিদার বাড়ির সামনে রশিক রায় মন্দিরের মাঠে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী দইমেলা বসত। প্রতি বছর শীত মৌসুমের মাঘ মাসের শ্রী পঞ্চমী তিথিতে দইমেলায় বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ঘোষরা দই এনে মেলায় পসরা বসিয়ে বিকিকিনি করতেন।
আরও পড়ুন <> পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে মুখর মাটিয়ান দীঘি
সবচেয়ে ভালো সুস্বাদু দই তৈরিকারক ঘোষকে জমিদারের পক্ষ থেকে দামি ও মর্যাদাপূর্ণ উপঢৌকন দেয়ার রেওয়াজ ছিল। সেই নিয়ম মেনেই তাড়াশের দইয়ের মেলা এখনও মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতে উৎসব আমেজে বসার বার্ষিক রেওয়াজে এবারো বসবে।
দইয়ের মেলায় আসা এ অঞ্চলের দইয়ের স্বাদের কারণে নামেরও ভিন্নতা রয়েছে। যেমন শাহি দই, ক্ষীরশা দই, শেরপুরের দই, বগুড়ার দই, টক দই, শ্রীপুর দই, হান্ডিয়ালের দই, ডায়াবেটিকস দই।
এ রকম হরেক নামে দামের হেরফেরে বিক্রি হয় দই। বিশেষ করে বগুড়ার শেরপুর, চান্দাইকোনা, শ্রীপুর; সিরাজগঞ্জের তাড়াশের দই প্রচুর বেচাকেনা হয় দইমেলায়। তবে মেলা দিনব্যাপী হলেও চাহিদা থাকার কারণে কোনো ঘোষের দই অবিক্রীত থাকে না, যার কারণে মেলার আগেই ঘোষরা দই তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাড়াশের ঐতিহ্যবাহী দইমেলাকে উপলক্ষ করে এখনও চলনবিল অঞ্চলের সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ এ মিলনমেলায় মিশে যান অনায়াসে।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, সিরাজগঞ্জ’ শীর্ষক বইয়ে তাড়াশের এ দইমেলার বর্ণনা রয়েছে। বইটির প্রধান সম্পাদক শামসুজ্জামান খান বিস্তারিতভাবে এ মেলার বিবরণ দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, একসময় এ মেলায় ৭০০-৮০০ জন ঘোষ প্রায় আট থেকে ১০ হাজার মণ দই নিয়ে এসে বিক্রি করতেন। তখন অবশ্য মেলা হতো তিন দিনের। বর্তমানে দিনব্যাপী মেলায় কয়েকশ মণ দই বিক্রি হয়।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।