ছবি : সংগৃহীত
বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় কমেছে তরমুজের আবাদ। পাইকারি সিন্ডিকেটের কারণে ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, খেতে পোকামাকড় ও চোরের উপদ্রব বাড়া, চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক থেকে শুরু করে বীজ, সার ও কীটনাশকের দাম বেড়ে যাওয়া এর অন্যতম কারণ।
আবাদসংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন এনজিও থেকে বা ব্যক্তিপর্যায় থেকে অধিক সুদে ঋণ নিয়ে তরমুজ আবাদ করা হয়। কিন্তু আশানুরূপ লাভ না পাওয়ায় ঋণের জালে আটকা পড়ছেন কৃষকরা। তাই মৌসুমি এ ফলের চাষ থেকে দিন দিন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন তারা। তবে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তরমুজ চাষাবাদে আগ্রহী করে তোলার দাবি জানিয়েছেন এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা।
জানা গেছে, এবার বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় তরমুজ চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬১ হাজার ২৫৮ হেক্টর জমিতে। সেখানে ৪৬ হাজার ৮৪৫ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে পটুয়াখালীতে। সেখানে ২২ হাজার ৩৯৮ হেক্টর জমিতে ৭০ হাজার ৩৩৬ মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদন হয়েছে। এরপর রয়েছে ভোলার অবস্থান। এই জেলায় ১৫ হাজার ৫৮ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার ১৫০ মেট্রিক টন; বরগুনায় আট হাজার ১৭৭ হেক্টর জমিতে ৩৪ হাজার মেট্রিক টন; বরিশালে ৯৯৫ হেক্টর জমিতে আট হাজার ১৪০ মেট্রিক টন; পিরোজপুরে ১৪০ হেক্টর জমিতে ১৫০ মেট্রিক টন এবং ঝালকাঠীতে ৭৭ হেক্টর জমিতে ২৭৫ মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদিত হয়েছে।
গত সোমবার সকাল থেকে বরিশাল নগরীর ইলিশের মোকাম হিসেবে পরিচিত পোর্ট রোড খালে ভিড় করে অর্ধশতাধিক ট্রলার। প্রতিটি ট্রলারে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ও সর্বনিম্ন আড়াই হাজার পিস করে তরমুজ এনেছেন মাঠপর্যায়ের কৃষকরা। ভোলার বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছে এসব তরমুজ।
ভোলার চরফ্যাশন থেকে তরমুজ নিয়ে আসা কৃষক আবুল কাসেম জানান, প্রতি বিঘা জমিতে তরমুজ চাষের জন্য শ্রমিক থেকে শুরু করে বীজ, সার ও পেকে যাওয়ার পর তা কেটে ট্রলারে করে বিক্রি করতে নিয়ে আসা পর্যন্ত প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়। এ জন্য কৃষকরা বিভিন্ন এনজিও থেকে বা ব্যক্তিপর্যায় থেকে অধিক সুদে ঋণ নেন। তাদের লক্ষ্য, তরমুজ বিক্রি করে লাভ তুলবেন ঘরে। কিন্তু প্রতিবছর পাইকারি সিন্ডিকেটের কাছে হেরে গিয়ে ঋণ ও চড়া সুদের জালে আটকা পড়ছেন কৃষকরা।
কাসেম আরও জানান, তরমুজের ফলন আসার সঙ্গে সঙ্গে পোকার আক্রমণ শুরু হয়। এ সময় কীটনাশক ছেটাতে হয়। এরপর তরমুজ বড় হতে থাকলে শুরু হয় চোরের উপদ্রব। এ জন্য রাতভর পাহারা দিতে হয় কৃষকদের। তারপরও চোর ঠেকানো যায় না। আবার যখন বিক্রি করার জন্য পাইকারদের কাছে নিয়ে যান, তখন পড়তে হয় সিন্ডিকেটের কবলে। পাইকাররা জোটবদ্ধ হয়ে ছোট-বড়-মাঝারি তরমুজের দাম নির্ধারণ করে রাখেন।
মৌসুমের প্রথম দিকে তরমুজের দাম কিছুটা পাওয়া গেলেও আস্তে আস্তে আর পাওয়া যায় না জানিয়ে এই কৃষক জানান, কৃষকের সরাসরি বিক্রি জন্য একটি হাটের প্রয়োজন। যেখানে মাঠপর্যায়ের কৃষকরা খেত থেকে তরমুজ তুলে ওই হাটে নিয়ে যাবেন এবং কৃষকরা দাম নির্ধারণ করবেন। কারণ সারা বছর কৃষকরা পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করেন, অথচ যারা বছরে একবারও খেতে যায় না, সেই সিন্ডিকেট কৃষকদের খপ্পরে ফেলে লাভ তুলে নেয়। এ কারণে কৃষকরা তরমুজ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তাই তারা অন্য ফসলে ঝুঁকছেন বলে জানান তিনি। কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করলে এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা দিলে সবাই আগ্রহী হবে।
আরও পড়ুন <> ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা ৩৫ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে
কৃষক জোমেদ আলী বলেন, আমার নিজস্ব জমি নেই। চরফ্যাশনে জমি ভাড়া নিয়ে চার বছর ধরে তরমুজ চাষ করছি। কিন্তু তরমুজ বিক্রির পর তেমন লাভ থাকে না। ঋণের কিস্তি, জমির ভাড়া ও উৎপাদন খরচেই সব চলে যায়। তাই তরমুজ চাষ করার আর ইচ্ছা নেই। ইতোমধ্যে অনেক কৃষক এই আবাদ থেকে সরে এসেছেন। আর তরমুজ চাষাবাদ কমে গেলে এ অঞ্চলে অধিক মূল্যে তরমজু খেতে হবে বলে জানিয়ে দেন এই কৃষক।
জানতে চাইলে কৃষক হাসেম বলেন, রোজার শুরুতে অপরিপক্ব তরমুজ বেশি দামে বিক্রি করে লাভবান হয়েছেন কৃষক থেকে শুরু করে আড়তদাররা। কিন্তু এসব তরমুজ কেনার পর খেতে না পেরে এখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ক্রেতারা। এ কারণে অর্ধশতাধিক ট্রলারভর্তি তরমুজ বিক্রি করতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
তিনি আরও বলেন, এখানে বড় সাইজের তরমুজের ওজন আট থেকে ১২ কেজি পর্যন্ত। এমন ১০০ তরমুজের দাম হাঁকছেন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। আবার ছোট-বড় মিলিয়ে ১০০ তরমুজ চাইছেন আট থেকে ১০ হাজার টাকা। কিন্তু এতেও তাদের লাভ থাকছে না। তা ছাড়া ট্রলার প্রতি চার হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে। ঘাটে আসার পর চার থেকে পাঁচ জনের খরচ আছে।
পোর্ট রোড খালে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তরমুজ কিনতে আসেন পাইকারা। তাদের একজন হামেদ চৌকিদার জানান, তিনি প্রতি বছর পোর্ট রোড থেকে তরমুজ কিনে তা দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠান। বিভাগের ছয় জেলার তরমুজ আসে পোর্ট রোডে। এসব তরমুজ কিনে ট্রাকযোগে পাঠিয়ে দেন বিভিন্ন স্থানে। তবে তরমুজ কেনার পর ধাপে ধাপে টাকা দিতে হয়। এ টাকা দিতে না হলে তরমুজ থেকে ভালো লাভ করা যেত বলে জানান তিনি।
কৃষি বিপণন কর্মকর্তা রাসেল খান বলেন, তরমুজে এ বছর কৃষক দাম পেয়েছেন। নগরীর পোর্ট রোড আড়তদার ও সেখানে আসা কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে তিনি বিষয়টি জানতে পেরেছেন। তবে গত বছর বৃষ্টির কারণে তরমুজের পচন ধরায় তরমুজের চাষাবাদ কমেছে। এ বছর যেভাবে তরমুজের ফলন হয়েছে, তাতে আবারও কৃষক তরমুজ চাষে এগিয়ে আসবে।
বরিশাল বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক শওকত ওসমান বলেন, তরমুজ চাষে কৃষকদের কোনো ধরনের ক্ষতি হলে সে ক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। সব ধরনের ফসল থেকে কৃষক যাতে লাভবান হতে পারেন, সে বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিটি ফসলের বিপরীতে বীজ থেকে শুরু করে সার ও প্রণোদনা সারা বছর কৃষক পেয়ে থাকেন। মাঝেমধ্যে প্রাকৃতিক কারণে ফসলে সমস্যা দেখা দিলে পরবর্তী বছর চাষাবাদ কম হয়। তবে এ অবস্থা আর থাকবে না। তরমুজের ফলন আগামী বছর আরও বাড়বে বলে আশা করেন এই কর্মকর্তা।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।