লায়লা আহমেদ।
টাঙ্গাইলের মেয়ে লায়লা আহমেদ। লেখাপড়া ও বেড়ে ওঠা সবই টাঙ্গাইলের আদালত পাড়ায়। ১৯৯১ সালে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় বিবাহ হয় টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের ছেলে ঢাকা জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শফিকের সঙ্গে।
ছোট বেলা থেকে গাছ লাগানোর একটা অভ্যাস ছিল লায়লার। বিয়ের পর চলে আসেন স্বামীর সঙ্গে ঢাকায়। ঢাকাতে এসে গ্রাজুয়েশন করার জন্য কলেজে ভর্তি হোন। কিন্তু বিয়ের পরে লেখা পড়া করতে ভালো লাগত না তার। আর লেখা পড়ার জন্য কোনো চাপও ছিল না।
স্বামী আইনজীবী সারাদিন সে বাইরে থাকে। বাসায় একা থাকতে লায়লা আহমেদের অনেক কষ্ট হয়। উড়ো উড়ো মন বাধা হয়েছে চার দেয়ালের মাঝে তখন কী করবেন! হাসবেন না কাঁদবেন, গান করবেন না নাচ করবেন। কোনো কাজেই মন বসতো না, কাজে আনন্দ পেতো না। তখন বারান্দার টবে শৌখিন ফুলের গাছ লাগানো শুরু করেন। সকালে বিকালে গাছে পানি দেয়া, পরিচর্যা করা, সারাদিনের কিছুটা সময় কাটে লায়লার। পরে ভাবতে থাকেন তিনি গাছ লাগাবেন। তবে কোথায় লাগাবেন? ভাবতে থাকেন...
ঢাকা শহর হচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান কর্মক্ষেত্র। জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ দলে দলে ঢাকা শহর মুখি হচ্ছে। বাড়ছে জনসংখ্যা, বিস্তৃত হচ্ছে পরিধি। মানুষের জন্য আবাসন, অফিস, কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তা ঘাট ইত্যাদি তৈরি করার প্রয়োজনে দিনে দিনে খালি জায়গায় ভরে উঠছে অবকাঠামো। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ কেটে ফেলছে গাছপালা নষ্ট হচ্ছে সবুজ প্রকৃতি। খেলার মাঠ, সবুজায়ন, পার্ক, খোলা জায়গা পরিবর্তিত হচ্ছে ধীরে ধীরে ইট কংক্রিটের চত্বরে, প্রকৃতি হচ্ছে বিপন্ন। লায়লা যেভাবে বেড়ে উঠেছে তার সন্তানরা কি সেভাবে বেড়ে উঠতে পারবে! পাবে বুক ভোরে শ্বাস নেয়ার জন্য অক্সিজেন! সাত-পাঁচ অনেক ধরনের ভাবনা তিনি ভাবতে থাকেন।
তিনি বৃক্ষ মেলাতে যান ও অনেক ধরনের শৌখিন ফুল ফল ও অরনামেন্টাল পাতার গাছ কিনে নিয়ে আসেন। সেগুলো বারান্দায় ও বারান্দার গ্রিলে ঝুলিয়ে রাখেন। পুরো বারান্ধাটা ভোরে ফেলেন গাছ লাগিয়ে। কিন্তু সারাদিনতো বারান্দায় সূর্যের আলো আসেনা গাছের বৃদ্ধি কম হয়। ফুল কম হয়। পরে ভাবলেন বাড়ির ছাদটাতো ফাঁকা। সে ফাঁকা জায়গায় গাছ লাগালে কেমন হয়!
তিনি বৃক্ষ মেলাতে দেখেন বনসাই গাছ। একটা ছোট্ট গাছ অনেক টাকা তার দাম। অল্প জায়গায় অনেক গাছ রাখা যায়। বনসাই গাছ দেখে তার মনের মাঝে জাগে সময় কাটানোর পাশাপাশি বনসাই করলে বিক্রি করে অর্থ পাওয়া যাবে। তারপর স্বামীকে বুঝাতে থাকেন তিনি ছাদে বাগান করবেন। প্রথমে স্বামী রাজী ছিলেন না পরে তিনি লায়লা আহমেদের কথায় রাজী হোন।
২০০০ সালে শুরু করেন ছাদে বাগানের কাজ। ছাদের পূর্ব পাশে বনসাই করার জন্য নির্ধারণ করেন। আর পুরো ছাদ জুড়ে সারি সারি করে টবে লাগিয়ে দেন হরেক রকমের ফুল ফল ও অরনামেন্টাল গাছ। সকালে বিকালে সারাক্ষণ তিনি ছাদের বাগানের পিছনে সময় দেন। বনসাই এর উপর বই জোগাড় করে পড়াশুনা করেন। গাছে পানি দেয়া, গাছ লাগানো, পরিচর্যা করা এ হচ্ছে লায়লা আহমেদের কাজ। বাড়ির ছাদের যেন কোন প্রকার ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে। গাছগুলো ছাদের বীম বা কলামের নিকটবর্তী স্থানে রাখলেন। ছাদ ড্যাম্প বা সেঁতসেঁতে যাতে হতে না পারে। এজন্য রিং বা ইটের উপর ড্রাম বা টব সমূহ স্থাপন করলেন। নিচে দিয়ে অনায়াসে আলো বাতাস চলাচল করলে ছাদ ড্যাম্প হতে রক্ষা পাবে। তারপর স্বামীকে বলে পুরো ছাদে নেট ফিনিসিং দিয়ে নিয়েছেন। আর ছাদের কোন প্রকার ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা নেই।
২০০৩ সালে এসে বনসাই বিক্রি শুরু করেন। তখন দেশে বনসাই গাছের চাহিদা শুরু হয় শুধু মাত্র বৃক্ষমেলাতে। ২০০৮ সালে বনসাই মেলা হয়। সে মেলায় লায়লা আহমেদ ৩০ হাজার টাকা দামে ১০টি বনসাই গাছ বিক্রি করেন। বর্তমানে নরমাল একটি বনসাই গাছের দাম ৫-৬ হাজার টাকা। তিনি ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত মূল্যে বনসাই গাছ বিক্রি করেছেন। তার গাছের চারা ক্রয় থেকে শুরু করে যত ধরনের খরচ হয়েছে তার পুরো টাকাই তুলে ফেলেছেন বনসাই গাছ বিক্রি করে।
লায়লা আহমেদের ছাদে আছে বারো মাসি আম, আম্রপালি, সিন্দুরী আমসহ বেশ কয়েক প্রকার আম, বারো মাসি পেয়ারাসহ বেশ কয়েক জাতের পেয়ারা, বাউ কুল, আপেল কুল, থাই কুল, লেবু ও কাগজি লেবুর বেশ কয়েকটা জাত, আমড়া, থাই করমচা, মিষ্টি তেঁতুল, কামরাঙা, কয়েক ধরনের ডালিম, চায়না কমলা, ভুটানি কমলা ও মাল্টা, আপেল জামরুল, নাশপাতি জামরল, স্ট্রবেরি, আতা, সপেদা, লাল শাক, পালং শাক, মুলা শাক, ডাটা শাক, কলমি শাক, পুঁইশাক, লেটুস, বেগুন, করলা, টমেটো, ফুল কপি, বাঁধা কপি, মরিচসহ হরেক রকমের ফুল ও অরনামেন্টাল প্লান্ট ইত্যাদি। এছাড়া তিনি ছাদে নারকেল ও কলাগাছ লাগিয়েছেন।
শুধু ফুল-ফল সবজিই নয়, লায়লা আহমেদ তার বাড়ির ছাদে মাছ চাষও করছেন। তার দুই ছেলে দুই মেয়ে। ২০০৮ সালে এসে ফরমালিন মুক্ত মাছ খাওয়ার জন্য তিনি ছাদের মাঝখানে একটা বড় হাউজ করেন। হাউজের দুই পাশে ৩০ মিটার লম্বা দুটি ক্যানেল করেছেন। সেখানে তেলাপিয়া, শিং, মাগুর, শোল, টাকি, কই ইত্যাদি মাছ চাষ করে আসছেন। আর বাইরে গেলে তিনি তাজা মাছ কিনে এনে হাউজে ছেড়ে দেন সেখানে দুই তিন দিন পালন করে পরে মাছটা ধরে খান। তখন মাছের স্বাদ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
বাজার থেকে ইলিশ মাছ ছাড়া আর কোন মরা মাছ তিনি ক্রয় করেন না। পুরো হাউজটা কচুরিপানা দিয়ে আচ্ছাদিত বলে মাছগুলো লাফিয়ে চলে যায় না। হাউজটা এমনভাবে করেছেন যে, পাশে উঁচু একটা টিলার অবয়ব সৃষ্টি করেছেন। টিলারের উপর থেকে পানি গড়িয়ে পড়লে মাছগুলো এসে তখন স্রোতের প্রতিকূলে লাফালাফি করতে থাকে। হাউজে মাছের লাফালাফির সাথে লায়লা-শফিক দম্পতির মনটাও লাফায়। মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েরা হাইজ থেকে বড়শি দিয়ে মাছ ধরে। বড়শীতে মাছ বাধলে ছেলেমেয়েরা খুশিতে লাফালাফি করে আনন্দ উল্লাস করতে থাকে। তখন লায়লার মনে হয় সত্যি ছেলে মেয়েদের খুশির জন্য কিছু করতে পেরেছি। স্বামী শফিক ভাবে এক সময় স্ত্রীর কথায় রাজি হতে চায়নি। আজ লায়লা সত্যি একটা সুন্দর কাজ করেছে।
আরও পড়ুন<<>> মাত্র আটটি হাঁসই মোড় ঘোরালো লেবু মিয়ার
সবাইতো ছেলেমেয়ের খুশি দেখার জন্য কাজ করে। এজন্য স্বামী তার উপর অনেক খুশি এবং স্বামী আগে অফিস থেকে ফিরলে লায়লাকে সহযোগিতা করেন। গাছে পানি দেন মাছের পানি পরিবর্তন করে দেন। নিকটতম কিছু আত্মীয় স্বজন আছে যারা এক সময় লায়লা আহমেদকে পাগল বলতো। বলতো ‘যার নেই কাজ সে লাগায় গাছ।’ তারা এখন বাসায় বেড়াতে আসলে রাত না থেকে যেতে চায়না। কারণ চাঁদনি রাতে ছাদ আরো ছন্দময় ও মধুময় হয়ে ওঠে। সবাইকে বেড়ানোর জন্য ডাকে তাজা হরেক রকমের নাম না জানা ফুলের গন্ধ, মিষ্টি মিষ্টি ফলের সান্নিধ্য, কোন কিছুই উপক্ষোর নয়। ছাদে এসে ফল খায়নি এমন কেউ তার ছাদে যায়নি।
ছেলে মেয়েরা রাতের বেলা ছাদে গিয়ে লুকোচুরি খেলে। সিড়িরুমের উপরের ছাদেও গাছগাছালিতে ভর্তি। অনেক দূর থেকে বাগান বিলাসী এই বাড়ির ছাদটি দেখা যায়। আশেপাশের বাড়িওয়ালারা বিকালে ছাদের পাশে এসে ঘুরঘুর করে। লায়লা আহমেদ পাকা ফল ছিড়ে অনেককে দেয়। স্বামী শফিকের বন্ধুবান্ধব কেউ বেড়াতে এলে তারাও ছাদে গিয়ে বিশ্রাম নেয়। আর এজন্য ছয়তলা বাড়ির এই ছাদের এক কর্নারে চা নাস্তা তৈরির ব্যবস্থা রেখেছেন। তবে লায়লা আহমেদের ছেলেমেয়েদের অভিযোগ যে, তাদের মা তাদের চেয়েও ছাদের বাগান গাছ-মাছকে বেশী ভালোবাসেন।
ছাদে বাগান করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সম্পর্কে লায়লা আহমেদ বলেন- হাফ ড্রাম, সিমেন্ট বা মাটির টব, ষ্টিল বা প্লাস্টিক ট্রে, সিকেচার, কোদাল, কাচি, ঝরনা, বালতি, করাত, খুরপি, প্রে মেশিন, দো-আঁশ মাটি, পঁচা শুকনা গোবর ও কম্পোস্ট, বালু, ইটের খোয়া ইত্যাদি। টব বা ড্রামের মাটি প্রতি বছর না হলেও ১ বছর অন্তর অন্তর পুরাতন মাটি পরিবর্তন করে নতুন গোবর মিশ্রিত মাটি দিয়ে পুনরায় টবটি/ড্রামটি ভরে দিতে হবে। এ সময় খেয়াল রাখতে হবে গাছ যেন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। লায়লা আহমেদ বালাই দমনে পরিবেশবান্ধব আইপিএম পদ্ধতি অনুসরণ করেন। বিশেষ প্রয়োজন ব্যতিরেকে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার না করে জৈব রাসায়নিক বালাইনাশক যেমন,নিমবিসিডিন, বাইকাও-১ ব্যবহার করেন। তার তত্ত্বাবধানে বেশ কয়েকজন ছাদে বাগান শুরু করেছেন।
আপন দেশ/এমবি/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।