Apan Desh | আপন দেশ

এক বাছুরেই আব্দুল হালিমের ভাগ্যবদল 

ড. বায়েজিদ মোড়ল 

প্রকাশিত: ১৪:৪৯, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১৫:৫৪, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

এক বাছুরেই আব্দুল হালিমের ভাগ্যবদল 

ছবি : আপন দেশ

বাস্তব জীবনে এক জনের সাফল্য সৃষ্টি করে অন্যের কর্মদ্দিপনা, আর বেগবান করে মনের মাঝে স্বপ্নের জাল বুনতে। এ স্বপ, মানুষ দু ভাবে দেখে। কেউ ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখে যার বাস্তবায়ন হয়না। দুঃশ্চিন্তা হয়। স্বপ্নভঙ্গ হয়ে কাঁদতে থাকে। আর কেউ নিরিবিলি বসে জীবন সাজানোর জন্য পরিকল্পনা করে, সুন্দর ভবিষ্যাতের জন্য স্বপ্নের প্যাটান তৈরী করে। যারা স্বপ্নবাজ ও জীবন সাজানোর কারিগর ও যারা স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে তারা আজ আমাদের মাঝে স্মরনীয বরনীয়। জীবন ঘেষা স্বপ্ন যারা দেখেন! যারা নিজেদের ভাগ্যের নিজেই নিয়ামক হোন তাদের মতো একজন গরুর খামারী ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার দত্তপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হালিম মাস্টার। পেশায় একজন শিক্ষক হলেও নেশা তার গরু লালন পালন করা।

লেখাপড়া শেষ করে চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে অবিরাম ছুটে চলেছেন আব্দুল হালিম। ছুটে চলেছেন এ অফিস থেকে ঐ অফিসে। ঢাকায়ও এসেছেন কয়েকবার পরীক্ষা দিতে। দুইবার লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করেন। তখন বুঝতে পারলেন মৌখিক পরীক্ষায় পাশ করে চাকরি পেতে হলে কিছু খরচা দিতে হয়। সে দেবার মতো সামর্থও ইচ্ছা কোনটাই আব্দুল হালিমের পিতার ছিলনা। বিএ পাশ করে ঘরে বসে বসে কেবল চাকরির ইন্টারভিউ দেবার জন্য পড়াশুনা করতে থাকেন। আর সারাক্ষন ভাবতেন তিনি কি করবেন! কি করে তিনি সাবলম্ভি হবেন! কিভাবে তার জীবন চলবে! কিভাবে পরিবারে সচ্চলতা আসবে! 

ভাবতে ভাবতে বিহব্বল হয়ে পড়েন তিনি। এর মধ্যে তার পিতা মারা যায়। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে পরিবার চালানোর দায় বার এসে পড়ে হালিমের উপর। পিতা কিছু দায় দেনা রেখে যান। এর মধ্যে একটা বোনের বিবাহ ঠিক হয় বোনের বিবাহ উপলক্ষে কিছু জমি বিক্রি করতে হয়। তখন ১৯৯৩ সালের কথা। সে জমি বিক্রি অর্থ দিয়ে বোনের বিবাহের সব খরচাদি শেষ করে ও পিতার রেখে যাওয়া দেনাও শোধ করার পর কিছু টাকা থাকে। এ টাকাটা দিয়ে তিনি কি করবেন ভাবতে ছিলেন তারপর ভাবলে একটা গরু কিনলে কেমন হয়? তখন আরো ভাবতে ছিলেন একটি দেশি জাতের গাভী যা খায় একটি বিদেশী জাতের গাভী তার চেয়ে অল্প কিছু খাবার বেশি খায় কিন্তু দুধ দিবে অনেক। আর এক গরুর এক রাখাল ১০ গরুরওতো এক রাখাল। তারপর তিনি ভাবলেন উন্নত জাতের গাভী পালন করে সাবলম্ভি হওয়া যায়। 

হতাশার সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে ১৯৯৪ সালে একটা বকনা বাছুর দিয়ে শুরু করেন জীবন গড়ার সংগ্রাম। ৩,২০০ টাকা দিয়ে হলেস্ট্রেইন ফ্রিজিয়ান জাতের একটি বকনা বাছুর কিনেন তিনি। পরে সেই বাছুর একের পর এক করে ৭ টি বাচ্চা দেয় তার বাড়ীতে। যাদের ৬ টি বকনা বাছুর হয় আর ১ টি ছিল ষাঁড় বাছুর। এর পর ১৯৯৫ সালে গাভী প্রথম বাচ্চা দেয় সকালে বাচ্চা প্রসব করিয়ে তিনি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হিসেবে মৌখিক পরীক্ষা দিতে যায়। পরীক্ষার হলেই তিনি টের পেয়ে যান তার চাকরি হবে। আর হলোও তাই। ভাগ্যের কি উন্নতি আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি হালিমের। পরে গাভী পুনরায় গর্ভবতি হয় বাচ্চা দেয় সে বাচ্চা বড় হয়। সে বাচ্চা আবার গাভীতে পরিনত হয়, বাচ্চা দেয়। এভাবেই হালিম মাষ্টারের সমস্থা হতাশা আর বেদনা দুর করে বিশাল খামার হয় হালিমের দত্তপাড়া গ্রামের বাড়ীতে। সুন্দর আধুনিক পদ্ধতির নিয়ম মেনে দুটি বড় পাকা সেড তোলেন। ২০০০ সালে নতুন আরো ১০ গাভী কিনেন সারি সারি বড় বড় দুটি সেড গাভী আর বাছুরের হাম্বা হাম্বা এক কলতান।

আরও পড়ুন<<>> বনসাই শিল্পী লায়লার স্বপ্ন, শহরে থেকে গ্রাম ছোঁয়া

খামার দেখাশুনার জন্য কর্মচারি আছে তিন জন পুরুষ ও দুই জন মহিলাকর্মী যারা তার প্রতিবেশী। খামারের গাভী আর বাছুরগুলো হালিম মাষ্টারের কাছে সন্তানের মতো, তাই রাতে ঘুমানোর আগে একবার সবগুলো গাভী ও বাছুরগুলোকে দেখে তারপর ঘুমাতে যায়। আবার খুব সকালে তিনি চলে আসেন খামারে। যতক্ষন বাড়ীতে থাকেন ততক্ষন তিনি খামারে থাকেন। গাভী দেখাশুনা করেন। কোন গাভী পায়খানা প্রসব করলে সঙ্গে সঙ্গে নিজেই পরিষ্কার করেন। হালিম মাষ্টারকে পরিষ্কার করতে দেখলে কর্মচারিরা আর কাজে ফাঁকি দিতে পারে না। খাবারের প্রতি নেন পচন্ড যত্ন। কোন গরুটা কি খাচ্ছে? কম খাচ্ছে না বেশি খাচ্ছে। কোন গাভী বা বাছুর অপুষ্টিতে ভুগছে কিনা? তার পর প্রাণিডাক্তার এলাকায় পাওয়া যায়না। উপজেলা সদরে যেতে হয়। তাদের খামারে এনে নিজে কিছু ট্রেনিংও নিয়েছে। কোন লক্ষণ দেখা দিলে গাভীকে কি খাওয়াতে হবে বা কি ভ্যাকসিন দিতে হবে? এটা ভালো করে আয়াত্ব করে নিয়েছে হালিম মাষ্টার। হালিম মাষ্টারের কাছে খামারের প্রতিটি গাভী ও বাছুর নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি প্রিয়। প্রতিটা গরুর জীবন বৃত্তান্ত তিনি লিখে রাখেন। জন্ম থেকে মৃত্য পর্যন্ত। 

হালিম মাষ্টারের উন্নতি দেখে দত্তপাড়া গ্রামের প্রায় প্রতিটা বাড়ীতে এখন গাভী পালন করা হয়। গত ২০১১ সালে দত্তপাড়া গ্রামকে ডেইরি ভিলেজ আখ্যা দিয়েছে মুক্তগাছা উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে।

মুক্তাগাছা অনেক আগে থেকে মাছ চাষের জন্য বিখ্যাত বলে পুরো এলাকাটা পুকুরে পরিণত হয়েছে। আর দত্তপাড়া ও আশাপাশের বেশ কিছু গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলার সময় চোখে পড়বে পুকুর আর পুকুরের পাশের বিলান জমিতে উন্নত জাতের ঘাষের আবাদ হচ্ছে।
উন্নত জাতের ঘাস ও প্রাকৃতিক ঘাসের ওপর দুগ্ধ উৎপাদন, গাভী প্রজণন ও বাচ্চা প্রসব নির্ভরশীল বলে বিকালে মোড়ে মোড়ে ঘাস বেচা কিনা হয়। আবার ঘাসের জমিও বিক্রি হয়। যে জমিতে ঘাস আছে ১৫ দিনের মধ্যে ঘাসগুলো কেটে আনতে হবে। তাতে গাভীর খামারীদের জন্য ভালো হয়। এক সময় বেশি ঘাস কিনে আনলে অনেক ঘাষ নষ্ট হয় সেদিক থেকে এভাবে ঘাসের জমি কিনলে ভালো হয়। নিজের খামারের গাভীর খাদ্যের কথা চিন্তা করে পৈত্রিক ও নিজের কিনা ১১ বিঘা খামার এলাকার পার্শ্বের ও দুরে বিলের জমিতে বিদেশি জাতের ঘাস চাষ শুরু করেন। এসব জমিতে বর্তমানে উন্নত জাতের পর্যপ্ত পরিমান ঘাস উৎপন্ন হচ্ছে। তিনি এলাকার বেকার যুবকদের গরু ছাগল পালনের সুফলসহ নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

হালিম মাষ্টার খামারে যে সব গাভীগুলো ভালো কেবল সেগুলোই খামারে রাখে অন্যগুলো বিক্রি করে ফেলে। আশেপাশের লোকজন হালিম মাষ্টারের কাছ থেকে গাভী কিনতে পারলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। গরু বাছুরের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বর্তমানে তার খামারে ৬০ টির মত গরু রয়েছে। এর বেশি গরু তার বাড়ীতে রাখা সম্ভব নয়। পুরাতন গৃহস্থ বাড়ী তাদের শারীক ভাগাভাগি হওয়ায় ও লোক সংখ্যা বেশি হওয়া বাড়ীর ভিতর বেশি জায়গা নেই। তারপর বাড়ীর পাশে সকল শরীকের মিলে একটা বিশাল পুকুর আছে । সে পুকুরের চার পাশেই চারটি চারজনের গরুর খামার। প্রতিদিন সকালে গরুর দুধ দোহানের পর গরুগুলো নিয়ে ঐ বিশাল পুকুর পাড়ে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে সেখানে সারাদিন খাবার খাওয়ায় ও গোসল করায় তারপর সন্ধ্যার আগে ঘরে নিয়ে আসে।

আরও পড়ুন<<>> মাত্র আটটি হাঁসই মোড় ঘোরালো লেবু মিয়ার

তার খামারের ১৭টি গাভী থেকে দৈনিক ২৫০ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। যাদের অনেকগুলো গাভী দৈনিক ৩০ লিটার করে দুধ দিচ্ছে। এ খামারের কোন গাভী ১০ লিটারের নিচে দুধ দিলে সে গাভীকে হালিম মাষ্টার বিক্রি করে দেন। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি গাভী বিক্রি করে এ পর্যন্ত তিনি কোটি টাকার উপরে গাভী বিক্রি করেছেন। যে টাকা দিয়ে তিনি গাভীর জন্য সেড তৈরী, নতুন গাভী ক্রয়, নিজ বসবাসের পাকা বাড়ী নির্মান ও বিলে প্রায় ২০ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন।তার এক ছেলে এক মেয়ে তারা পড়াশুনা করে।

তিনি নতুন খামারীদের উদ্দেশ্যে সতর্কতার জন্য বলেন খামারে লোকাসানে পড়ার কারণ হচ্ছে:
নুন্যতম প্রশিক্ষণ ছাড়াই কেউ খামার স্থাপন করলে এবং চিরাচরিত পদ্ধতিতে খামার পরিচালনা করা যাবেনা। পুঁজিহীন নিঃস্ব কোন ব্যক্তি খামার স্থাপন করা যাবেনা। কেবল ভাত/মাড় এবং ক্ষুদ/জাউকে গরুর একমাত্র খাবার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। নিজস্ব ক্ষেতে উৎপাদিত ঘাস বা খড় না থাকলে কিম্বা কেবল ক্রয় করা খাবারের উপর নির্ভরশীল হওয়া যাবেনা। আলো বাতাসহীন অস্বাস্থ্যকর এবং ক্ষুদ্র পরিসরে গবাদিপশু পালন করা যাবেনা। গবাদিপশুর প্রধান খাদ্য-কাঁচা ঘাস ও খড় এর যথাযথ বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। গাভী ঘন ঘন ওলান ফোলা রোগে আক্রান্ত হলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ ডাকারের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। খামারে দুগ্ধবিহীন শুষ্ক গাভীর সংখ্যা মোট গাভীর সংখ্যার তিনভাগের একভাগের বেশী রাখা যাবেনা। জন্মের পর খামারে বাছুর মারা যাওয়া ভালো নয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। খামারে ঘন ঘন রোগ দেখা দিলে এবং ক্ষুরারোগ হওয়ার আগে ভ্যাকসিন দিতে হবে। খাদ্য খরচ বেশী হচ্ছে এই ভেবে গাভীকে চাহিদার তুলনায় কম খাবার খাওয়ানো যাবেনা। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশী হলে। কম উৎপাদনের দুধের গাভী নিয়ে খামার গড়ে তুলা যাবে না। নির্দিষ্ট বয়সে এবং সময়ে বকনা/গাভী গরম না হলে এবং প্রতি বছর গাভী বাছুর জন্ম না দিলে সেদিকটা খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষজ্ঞ ছাড়া হাঁতুড়ে পরামর্শে খামার পরিচালনা করা যাবেনা।

গাভী পালন লাভজনক ব্যবসা খামারে বিনিয়োগ ও লাভজনক। গাভী পালন করে যে কেউ দারিদ্র অবস্থা থেকে সহজেই হতে পারেন স্বচ্ছল। বেকাত্ব থেকে মুক্তি পেতে পারেন। এতে তাদের বেকারত্ব ঘুচবে। তাছাড়া বর্তমানে এসব কর্মসুচিতে বাণিজ্যিক ব্যাংক সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে থাকে। তাই সামান্য পুজি নিয়ে যে কেউ গাভী পালন করতে পারেন। এতে মিটবে তার বেকারত্ব ঘুচবে পুষ্ঠি চাহিদা। বন্ধ হবে দুধ আমদানিতে ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা খরচ।

আপন দেশ/জেডআই

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়