Apan Desh | আপন দেশ

শখের পাখি জীবনের গতি বদলে দিয়েছে মিলনের

ড. এম বায়েজিদ মোড়ল

প্রকাশিত: ১৮:৩৯, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

শখের পাখি জীবনের গতি বদলে দিয়েছে মিলনের

ছবি: আপন দেশ

রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার বালিয়াপুকুর গ্রামের মিলনুর রশীদ মিলন। পিতা মারা যাওয়ার পর সংসারের সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় তিনি। তখন হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন মিলন। সংসারের খরচ মেটাতে মটর গাড়ির পার্টসের দোকান দেন। দিন চলে গেলেও অর্থনৈতিক সংকট ছিল।

মিলনের দোকানের পাশেই ছিল একটি পাখি বিক্রির দোকান। দোকানদার মো. রেজাউর রহমান আপেল ছিলেন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি পাখি বিক্রির পাশাপাশি মোবাইল ফোনে টাকা লোডও করতেন। একদিন আপেলের পরামর্শে মিলন খাঁচায় পাখি পালনের কথা ভাবেন। প্রথমে ভয় পেলেও, ২০০৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় সিদ্ধান্ত নেন শখের বশে ২০টি বাজরিকা পাখি কিনে পালন শুরু করবেন।

এরপর ২০০৭ সালের কথা। তখন মিলন ইন্টারমিডিয়েট এ পড়ে। পড়াশুনা আবার সংসার চালানোর জন্য মটরপার্টসের দোকানে বসা। তারপরও নতুন কিছু একটা করতে হবে এ বাসনা তার মনের মাঝে ঝেঁকে বসে।

একদিন মিলন তার খালার বাসায় বেড়াতে গিয়ে খালাকে খাঁচায় কবুতর পালতে দেখে। দৃশ্যটি তাকে আকৃষ্ট করে। বাসায় ফিরে তিনি আপেলের সঙ্গে পরামর্শ করেন। আপেলের পরামর্শে শখের বশে ২০টি বাজরিকা জাতের পাখি কিনে খাঁচায় পালন শুরু করেন।

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পাখির সেবা, তারপর কলেজে যাওয়া, বিকেলে ফিরে এসে আবার পাখির যত্ন নেয়া—এভাবে মিলন তার পাখির খামারের প্রতি একাগ্রতা দেখান। তার যত্নে পাখিরা দ্রুত ডিম পাড়ে ও বাচ্চা দেয়, ফলে এক বছরের মধ্যে তার খামারে পাখির সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায়।

পাখি উৎপাদনে সফলতা পেয়ে মিলন তার খামারটি বাণিজ্যিক খামারে পরিণত করার পরিকল্পনা করেন। আপেলের পরামর্শে তিনি লাভবার্ড, ককাটেল, লংটেল, ফিন্স, ডায়মন্ড ডোব, অস্ট্রেলিয়ান বার্ড ও বিদেশি ঘুঘুসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি কিনে তার খামারে পালন শুরু করেন।

মিলনের বাড়ি একতলা হলেও তিনি তার খামারের জন্য বাড়ির ছাদের একপাশে দোতালা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে ছাদ নির্মাণের সুযোগ না পেয়ে, টিনের ছাবড়া দিয়ে পাখিদের জন্য নতুন স্থান তৈরি করেন। সময়ের সাথে তার খামারে পাখির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সেক্ষেত্রে তিনি পাশের একটি জায়গা সম্প্রসারণ করে সেখানে আরও কিছু পাখি পালন শুরু করেন। একতলা বাড়ির পূর্ব পাশে দেয়াল তুলে সেখানে নতুন করে পাখির স্থান তৈরি করেন। বর্তমানে তার বাড়িতে তিনটি ঘরে পাখি পালিত হচ্ছে।

মিলন ১৮০০ টাকার পাখি নিয়ে খামার শুরু করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে প্রতি মাসে ১৮ হাজার টাকার উপরে পাখি বিক্রি করেন। তার খামারে প্রায় ৩ শতাধিক বাজরিকা পাখির প্যারেন্ট স্টকসহ অন্যান্য প্রজাতির পাখি রয়েছে, যেমন—লাভবার্ড, ককাটেল, লংটেল, ফিন্স, ডায়মন্ড ডোব, অস্ট্রেলিয়ান বার্ড, বিদেশি ঘুঘু ইত্যাদি। পাখিগুলো তিনি খাচা ও হাড়ি পদ্ধতিতে পালন করছেন।

মিলনের খামারের পাখিরা খাঁচায় ডিম পাড়ে, কিন্তু ডিম পাড়ার পর বাচ্চা উৎপাদনে কিছুটা অসুবিধা বোধ করত। তবে মিলন তার খামারের উন্নতি ও পাখি উৎপাদনে নিয়মিত মনোযোগ দিচ্ছেন, যার ফলস্বরূপ তিনি সফলভাবে পাখি পালন ও বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছেন।

আরও পড়ুন>>>বনসাই শিল্পী লায়লার স্বপ্ন, শহরে থেকে গ্রাম ছোঁয়া

মিলন আপেলের পরামর্শে মাটির হাড়ির মাধ্যমে পাখির প্রজনন কার্যক্রম শুরু করেন। ১ জোড়া প্রাপ্তবয়স্ক পাখি বছরে ৩-৪ বার প্রজননে অংশ নেয়। প্রতিবারে ৬-৮টি ডিম পাড়ে। সেসব ডিম থেকে বাচ্চা হয়ে, মাত্র ৪-৫ মাসেই তারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায়। এ চক্রবৃদ্ধির মাধ্যমে তার খামারে পাখির সংখ্যা অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে। তবে মিলন খামারের ধারণক্ষমতা সীমিত রাখতে চেয়েছিলেন। ৫০০টি প্যারেন্ট স্টক রাখার পরিকল্পনা করেন। পাখির বাচ্চা বিক্রি করে তিনি নতুন প্যারেন্ট স্টক তৈরি করেন।

আরও পড়ুন>>>মাত্র আটটি হাঁসই মোড় ঘোরালো লেবু মিয়ার

প্রতি মাসে তার খামারে ২০০টির বেশি পাখি জন্ম নেয়। এ পাখিগুলো আপেলের মাধ্যমে ঢাকার কাটাবন মার্কেটে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি বুদ্ধি, পরামর্শ, ওষুধ ও সরঞ্জামাদি পেয়েছেন যা তার খামারের উন্নতি করেছে। স্থানীয় বাজারে প্রতি সপ্তাহে ২০-২৫ জোড়া পাখি বিক্রি করেন, যেখানে প্রতি জোড়া পাখির মূল্য গড়ে ৩৫০-৪০০ টাকা। বর্তমানে তার খামারে প্রায় ৩ লাখ টাকা মূল্যের পাখি রয়েছে।

মিলন যে পিলারে একসময় দুশ্চিন্তায় দাঁড়িয়ে ভাবতেন, আজ সে ফিলারের উপরে তার শখের পাখির ঘর তৈরি হয়েছে। পাখি বিক্রি করে সে এখন মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা আয় করেন। তার বাড়ি এখন ‘পাখি বাড়ি’ নামে পরিচিত। মিলন তার ছোট বোনের বিয়ে দিয়েছে, এরপর নিজের বিয়ে করেছে। এখন তার একটি ছেলে রয়েছে। সুখী জীবন এখন তার।

আপন দেশ/এমবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়