ফাইল ছবি
জলবায়ু পরিবর্তন, মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলন, সারাদেশে অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে প্রতিবছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উদ্বেগজনকভাবে নেমে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় সামনের দিনগুলোতে সুপেয় পানির ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হবে বলে বার্তা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের শঙ্কা, ভূপৃষ্ঠেরও অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন হতে পারে। ভয়ের কথা, ঘটতে পারে ভূমিকম্পের মতো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগও।
তাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমানো জরুরি। একইসঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব পানির স্তুর নেমে যাওয়া রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে সারাদেশে সুপেয় ও নিরাপদ পানি সরবরাহে কাজ করে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। তাদের করা জরিপে উঠে এসেছে, মাত্রাতিরিক্ত নগরায়ণের কারণে রাজধানী ঢাকা, সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে ভয়াবহভাবে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এসব এলাকায় প্রতিবছর গড়ে দুই থেকে তিন মিটার পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এতে করে ঢাকা ও এর আশপাশে এক সময় নিরাপদ পানির ভয়াবহ সংকট দেখা দিতে পারে।
ঢাকা মহানগরীকে ১০টি জোনে ভাগ করে পানি সরবরাহ করে ঢাকা ওয়াসা। তাদের সরবরাহকৃত পানির ৬৭ শতাংশ গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা হয়। এ জন্য ৯০৬টি গভীর নলকূপ রয়েছে ওয়াসার। অবশিষ্ট ৩৩ শতাংশ পানি আসে ভূ-উপরস্থ উৎস থেকে।
ঢাকা ওয়াসার তথ্যমতে, প্রতিবছর দুই থেকে তিন মিটার করে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। আগে যেখানে ৫০ থেকে ৬০ মিটারের মধ্যে পানি পাওয়া যেত- এখন সেখানে ৮০, ৯০ মিটারে গিয়েও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের জরিপে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ পানি ব্যবহৃত হয় চাষাবাদে, যার সিংহভাগেরই উৎস ভূগর্ভ। গৃহস্থালি ও শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত হয় ১০ শতাংশ পানি। এর মধ্যে পানের জন্য ব্যবহৃত হয় এক শতাংশ।
গবেষকদের ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে- রাজশাহী, রংপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়াসহ বরেন্দ্র এলাকার এঁটেল মাটির কারণে সেসব এলাকায় পানি নিচে নামতে পারে না। ফলে পানির সংরক্ষণ কমে যাচ্ছে। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণেও পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
রাজধানী ও এর আশেপাশের এলাকার মতো না হলে সারাদেশের অবস্থা শঙ্কাজনক। আমাদের দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, সারা দেশের মতো দিনাজপুরেও চলছে তীব্র দাবদাহ। প্রচণ্ড গরমে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর উঠেছে নাবিশ্বাস। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিও বিরূপ আচরণ করছে। এই রোদে মাঠে কাজ করতে পারছেন না খেটে খাওয়া মানুষেরা।
দিনাজপুর উত্তর বালুবাড়ির বাসিন্দারা জানান, মেশিন দিয়ে পানি উঠানো যায় না আগের মতো। পানির লেয়ার কমতে শুরু করেছে শহরে বিভিন্ন জায়গাতে।
মুন্সিপাড়ার বাসিন্দা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বিমন পাল বলেন, আমার বাড়িতে ব্যবহৃত পানির মোটরটি আর ভালো সার্ভিস দিচ্ছে না। মেকারকে দেখানো হলে জানতে পারলাম মোটর ঠিক থাকলেও পানির লেয়ার নেমে গেছে।
দিনাজপুরের বালুবাড়ি টিকিয়া পাড়ায় বেসরকারি এক স্কুল শিক্ষক বলেন, আমার বাড়ির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় বসবাসরত ভাড়াটিয়ারা পানির সমস্যায় ভুগছেন গত সপ্তাহ থেকে। তাদের ব্যবহৃত পানির কলে পানি থাকছে না। পানি না থাকায় গৃহস্থালী কাজের ব্যাঘাত ঘটছে।
দাবদাহে মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখিদেরও জীবন বিপর্যস্ত। বোবা প্রাণীরা গরম সহ্য করতে না পেরে বাসা বাড়িতে আশ্রয় খুঁজছে।
দিনাজপুর পৌর মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অনাবৃষ্টির কারণে পানি নেমে গেছে। আমি বলবো আপনারা যারা বাসাবাড়িতে পানির পাম্প ব্যবহার করেন, তারা পানির ট্যাংকে এলার্ম মেশিন লাগিয়ে দিন। ট্যাংক ভর্তি হয়ে গেলে ওভারফ্লো হয়ে পানির অপচয় হবে না। পানির অপচয় না করে সচেতন হোন। পানির সঠিক ব্যবহার িনিশ্চিৎ করুন। পশু-পাখিদের পিপাসা মেটানোর জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান মেয়র জাহাঙ্গীর।
পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী (পানি) জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দিনাজপুরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এ কারণে ছোট-বড় সকল ধরনের পাম্পে পানির সরবরাহ কমে গেছে। পানির লেয়ার নিচে নেমে গেছে। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হলে লেয়ার উপরে চলে আসবে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকা এবং ভোল্টেজ প্রয়োজনের তুলনায় কম হওয়ায় পানি উত্তোলনে সমস্যা হচ্ছে।
জেলার বিক্রয় বিতরণ বিভাগ-২ (নেসকো)-এর নির্বাহী প্রকৌশলী শাহাদাত হোসেন জানান, শহরে দিনের বেলায় বিদ্যুতের চাহিদা অনেক। অথচ উৎপাদন হচ্ছে ১৪ মেগা মেগাওয়াট।
দিনজপুর জেলার সিভিল সার্জন ডা. এ. এইচ. এম বোরহানুল ইসলাম সিদ্দিকী আপন দেশকে বলেন, অতিরিক্ত তাপপ্রবাহে মানুষের হিট স্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন, অতিরিক্ত ঘামের কারণ ইলেক্ট্রোলাইট ইন ব্যালেন্স হতে পারে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কিডনি বিকল, অজ্ঞান, মাসল পুল, গলা বসে যাওয়া, নাক বন্ধ, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ধুলাবালির কারণে অ্যাজমা জনিত এলার্জি হতে পারে। এসব থেকে পরিত্রাণেরস জন্য প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার- পানি, দুধ, স্যালাইন, শরবত, ফলের রস খেতে হবে। রোদে যাবার আগে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
ভূগর্ভস্থ পানিবিজ্ঞান পরিদফতরের পরিচালক (জিওলজি) ড. আনোয়ার জাহিদ বলেন, পানির স্তর নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ ভূগর্ভস্থ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন। যে পারিমাণে পানি উত্তোলন করা হয়, সেই পরিমাণ পানি রিচার্জ হচ্ছে না। আগামী দিনের জন্য এটি এক মারাত্মক ঝুঁকি। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় পানি পাওয়া যাবে না।
তিনি আরও বলেন, সারাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, যা বর্ষা মৌসুমে আগের অবস্থায় ফিরছে। কিন্তু দুই-তৃতীয়াংশ এলাকাতেই পানির স্তর নেমে যাওয়ার পর আর আগের অবস্থায় ফিরে আসছে না। এটিই ভয়ের কারণ।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এএইচএম খালেকুর রহমান বলেন, পানির স্তর বেশি নামছে বরেন্দ্র অঞ্চলে, ঢাকা ও এর আশপাশে এবং খরাপ্রবণ এলাকায়। সাধারণত ভূগর্ভের আট মিটার গভীরে পানি পাওয়া না গেলে আমরা গভীর নলকূপের পরামর্শ দিই। দেশের বড় একটি অংশে পানির স্তর ভয়াবহভাবে কমছে। বিশেষ করে যেখানে যেখানে নগরায়ণ হচ্ছে সেখানেই পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ নগরায়ণের ফলে পানি নিচে রিচার্জ হওয়ার সুযোগ পায় না।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশের বরেন্দ্র এলাকা, খরাপ্রবণ এলাকা, আরবান এলাকা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটাপন্ন এলাকা, বেড়িবাঁধ এলাকার পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।
আপন দেশ/আরএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।