ছবি: আপন দেশ
পৌর মেয়র, এসিল্যান্ড কিংবা জেলা প্রশাসক। বালু দস্যুদের রুখতে ব্যর্থ হয়েছেন সকলেই। ঝালকাঠি বাসীর এখন শেষ ভরসা প্রধানমন্ত্রীই। বালু খেকোদের রুখতে হস্তক্ষেপ চান তারা। দেদার বালু উত্তোলনে সুগন্ধা নদীতে বিলীন হচ্ছে আবাদি জমি ও বসতভিটা। ভুক্তভোগীদের দাবি, বালু দস্যুদের কারণে আবাদি জমি ও বসতভিটা হারিয়েছেন অনেকে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রতিকার করতে ব্যর্থ হওয়ায়, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান তারা।
জানা যায়, জেলা সদরের লঞ্চ টার্মিনাল থেকে নলছিসি লঞ্চঘাট; সুগন্ধা নদীর প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় চলছে দেদারচে বালু উত্তোলন। ইতোমধ্যেই উপজেলার ভাঙনকবলিত তিনটি গ্রাম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ভাঙনের মুখে দিয়াকুল খেয়াঘাটের সেতু, কিস্তাকাঠি সাইক্লোন শেল্টারসহ বহু স্থাপনা। স্থানীয়দের শংকা, যেকোন সময় ধসে পড়তে পারে ঝালকাঠি শহর রক্ষা বাঁধ। বিলীন হতে পারে সদরের কুতুবনগর বাসস্ট্যান্ডও।
দুই সপ্তাহের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুগন্ধা নদীর কোথাও সরকারিভাবে ঘোষিত বালু মহাল নেই। তবে এর তোয়াক্কা করছে না প্রভাবশালী চক্র। দিনে চুপচাপ থাকলেও বিকেল পাঁচটার পর নদী এলাকায় চলে বালু তোলার মহোৎসব। অন্তত ২-৩ ঘণ্টায় তিন-চারটি ড্রেজারে আনুমানিক ৫০ হাজার ফুট বালু লুট করে চক্রটি। আনুমানিক মূল্য ৪৫ লাখ টাকা। রাতে আরও তিন-চারটি ড্রেজারে তোলা হয় বালু। সব মিলিয়ে দিনে লক্ষাধিক ফুট বালু তুলে নেয় প্রভাবশালী চক্রটি।
এলাকাবাসী জানায়, দেদার বালু তোলার কুফল পড়েছে এলাকায়। কিস্তাকাঠি মসজিদ ও খেয়াঘাট, দিয়াকুল মসজিদ ও খেয়াঘাট ইতোমধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে। আবাদি জমি ও বসতভিটা হারিয়েছেন অনেকে।
দিয়াকুলের বাসিন্দা কৃষক মজিদ আলীর ভাষ্য, তার মালিকানাধীন ১২ কাঠা নদীতে বিলীন হয়েছে। পাশের দেউরী গ্রামের কেরামত মিয়ার ১০ কাঠা ও আলমগীর হোসেনের ২০ কাঠা জমি নদীর পেটে গেছে। গাবখান ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের কিস্তাকাঠি গ্রামের বাসিন্দা রোকসানা বেগম জানান, তার পরিবার ১৬ কাঠা জমি হারিয়েছে।
ড্রেজার (খননযন্ত্র) চালুর সঙ্গে সঙ্গে নদীতীরে ধস দেখা দেয়। এতে গ্রামবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বলে জানান কিস্তাকাঠির গ্রামের আসলাম হাওলাদার ও স্থানীয় মসজিদের ইমাম রবিউল ইসলাম। দ্রুত সময়ের মধ্যে বালু দস্যুদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযানের দাবি জানিয়েছেন তারা। না হলে দিয়াকুল, দেউরী ও কিস্তাকাঠি গ্রাম তিনটি বিলীন হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন এলাকাবাসী।
বালু তোলায় কর্মরত কয়েকজন শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এ ব্যবসায় তিন ধরনের নৌ-যান ও খননযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। নদীর তলদেশ থেকে বালু তোলায় ব্যবহার করা হয় ড্রেজার। সেখান থেকে বালু তীরে নেওয়া হয় বাল্কহেডে করে। তীরে ভেড়ানো বাল্কহেড থেকে পুকুর-জলাশয় ও কৃষিজমি ভরাটের জন্য আরেকটি যন্ত্র বসানো হয়েছে কয়েকটি এলাকায়।
জানা গেছে, সামর্থ্য অনুযায়ী বালু দস্যুরা তিনভাগে বিনিয়োগ করে থাকে। প্রতি বর্গফুট বালু তোলার খরচ ৫০ পয়সা। বিক্রি হয় ৫-১০ টাকায়। এভাবে প্রতি রাতে প্রায় কোটি টাকার বালু লুট করে সরকারের বিপুল রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে চক্রটি। এতে জড়িত ব্যক্তিরা রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে রূপান্তরিত হয়েছেন।
ঝালকাঠি লঞ্চঘাট এলাকায় বালু তোলার কাজ সমন্বয় করেন একই এলাকার বাসিন্দা আবদুল হক খলিফা। ৭ জানুয়ারি তার মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি দাবি করেন, ‘আমি এই ব্যবসার সঙ্গে এখন জড়িত নই। মোবাইলে বালু উত্তোলনের বিষয়ে কথা বলা যাবে না। এদের নেটওয়ার্ক অনেক বড়। আপনার তো জানার কথা!’
পৌর এলাকার চাঁদকাঠির বাসিন্দা সুলতান হোসেনের একটি ড্রেজার ব্যবহার করে বালু তোলা হচ্ছে সুগন্ধা-গাবখান নদীর মোহনা থেকে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন তিনিও। একই দিন (৭ জানুয়ারি) সুলতান বলেন, ‘প্রশাসন আমাদের (বালু তোলায়) বাধা দেবে কেন? সরকারি কাজে যে বালু লাগে তা পাবে কোথায়? আমরাই তো তাদের এই বালু দিয়ে সহায়তা করি।’
স্থানভেদে বালু ৫ থেকে ১০ টাকা বর্গফুট বিক্রি করেন সুলতান হোসেন। তার দাবি, ‘আমি ছাড়াও অনেকের ড্রেজার আছে। এতে খরচ আছে। তাই ফুট (দাম) বেশি পড়ে।’ এই কাজ বন্ধ করলে সব উন্নয়ন কাজ বন্ধ হয়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেন।
দিয়াকুলের বাসিন্দারা জানায়, তাদের যাতায়াতের সুবিধার্থে নির্মাণ করা অস্থায়ী সেতুটি নদীভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। বালু দস্যুদের কারণে দিয়াকুল ১ নম্বর মৌজার ৪৬০ কুড়া (৬০ শতাংশে এক কুড়া) জমি সুগন্ধায় বিলীন হয়েছে। কিছুদিন আগেই এ গ্রামের আবুল হোসেনের বাড়িসংলগ্ন বেড়িবাঁধের একটি অংশ ধসে যায়।
শাহিন খান বলেন, ‘শস্যের মধ্যে ভূত থাকলে কীভাবে ভূত তাড়াবেন? আমরা তো যেখানে যতটুকু বলার বলি। কিন্তু এরা (বালু দস্যু) সব ম্যানেজ করে এ কাজ করছে। তাই নদীভাঙন থামছে না। আমার বাড়িও নদীর খুব কাছে চলে এসেছে।’
এলাকাবাসীর ভাষ্য, নদীর নলছিটি উপজেলার অংশে জেলা প্রশাসন কয়েক দফায় অভিযান চালিয়ে ড্রেজার জব্দ, শ্রমিক আটক ও জেল-জরিমানা করেছে। এতেও বন্ধ হচ্ছে না বালু দস্যুদের দৌরাত্ম্য। ঝালকাঠি সদরের অংশেও এমন অভিযানের দাবি জানান। তারা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী, ভূমিমন্ত্রী ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী বরাবর অভিযোগ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে গণস্বাক্ষর সংগ্রহের কাজ চলছে।
সদর উপজেলার ইউএনও অনুজা মণ্ডল অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের ছাড় না দেয়ার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, এর আগে একাধিক অভিযান পরিচালিত হয়েছে। বালু দস্যুদের বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহায়তা করার জন্য আহ্বান জানান তিনি।
আপন দেশ/এবি/এসএমএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।