Apan Desh | আপন দেশ

আবদুল্লাহর নাবিক জানালেন জিম্মিদশার দুঃসহ কথা

চট্টগ্রাম ব্যুরো

প্রকাশিত: ১২:৫৩, ২২ এপ্রিল ২০২৪

আবদুল্লাহর নাবিক জানালেন জিম্মিদশার দুঃসহ কথা

ছবি : সংগৃহীত

এমভি আবদুল্লাহর নাবিক (সাধারণ স্টুয়ার্ড) মোহাম্মদ নুর উদ্দিন সোমালিয়ান জলদস্যুদের কাছে জিম্মি থাকার দুঃসহ স্মৃতি বললেন। তিনি বলেন, ‘দস্যুদের কবল থেকে বেঁচে ফিরবো, কখনো চিন্তাও করিনি। মনে করেছি এ বুঝি আমি শেষ।’

এমভি আবদুল্লাহ রোববার (২১ এপ্রিল) বাংলাদেশ সময় বিকাল সাড়ে ৪টা নাগাদ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই আল হারমিয়া বন্দরের বহির্নোঙর করে। ওই জাহাজে আছেন দস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া ২৩ নাবিক।

জিম্মিদশায় কাটানো দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা স্মরণ করে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ নুর উদ্দিন বলেন, ‘১২ মার্চ দুপুরের দিকে আমরা জলদস্যুদের কবলে পড়ি। তখন মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে দুবাই যাচ্ছিলাম। দস্যুরা বড় একটি মাছ ধরার নৌযান থেকে একটি স্পিডবোট নামায়। পরে স্পিডবোটে করে চার জন-চার জন করে দস্যু আমাদের জাহাজে উঠতে থাকে। প্রথম দিকে মোট ১২ জন দস্যু ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি দস্যুরা যাতে জাহাজে উঠতে না পারে। তখন সাগর একেবারেই শান্ত ছিল। বলা যায় পুকুরের মতো। বড় বড় ঢেউ থাকলেও তারা আমাদের জাহাজে উঠতে পারতো না। জাহাজে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা ছিল। এমনিতেই সাগরের পানি থেকে জাহাজের উচ্চতা কম। যে কারণে অতি সহজেই দস্যুরা জাহাজে উঠে যায়।’

আরও পড়ুন <> রাশিয়া থেকে কয়লা আমদানি কমিয়েছে চীন

তিনি বলেন, ‘দস্যুরা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর আমাদের জিম্মি করে ফেলে। অত্যাধুনিক সব অস্ত্র আমাদের মাথায়-বুকে তাক করে রাখে। মনে হচ্ছিল এ বুঝি মেরে দিলো। তাদের (দস্যুদের) নির্দেশনা মেনে জাহাজ নিয়ে যাওয়া হয় সোমালিয়ান উপকূলে। সেখানে নোঙর করার আগে থেকে অপেক্ষমাণ ছিল আরও বেশ কিছু দস্যু। যাদের কাছে জাহাজে থাকা দস্যুদের থেকেও ভারি অস্ত্রশস্ত্র ছিল। তারাও জাহাজে ওঠে। তখন সব মিলিয়ে ৩৫ থেকে ৩৮ জন দস্যু ছিল। পর্যায়ক্রমে আরও বেশ কজন দস্যু জাহাজে যুক্ত হয়।’

নুর উদ্দিন বলেন, ‘দস্যুরা আমাদের সব সময় নজরদারিতে রাখতো। আমাদের বুকে কিংবা মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে রাখতো। মনে হতো এই বুঝি গুলি করে দিলো। এমনকি জাহাজের বাইরেও আমাদের তাকাতে দিতো না। আমাদের তারা একা চলতে দিতো না। তাদের (দস্যু) মধ্যেও এক ধরনের ভয় কাজ করতো; আমরা কোনো ফন্দি করছি কিনা।’

তিনি বলেন, ‘দস্যুদের কবলে পড়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি যুদ্ধজাহাজ অনেকটাই আমাদের জাহাজের কাছে চলে আসে। তাদের একটি হেলিকপ্টারও আমাদের জাহাজের ওপর চক্কর দিতে থাকে। তবে দস্যুরা এসবে ভয় পায়নি। যুদ্ধজাহাজ কাছে এলে দস্যুরা আমাদের ওপর বন্দুক তাক করে রাখে। আমাদের জাহাজ থেকে দস্যুদের নেমে যেতে বলেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী। এমনকি এক থেকে দশ পর্যন্ত কাউন্ট করেছিল। এরপর নৌবাহিনী ফাঁকা গুলিও ছুড়েছে। দস্যুরা আমাদের ওপর বন্দুক তাক করে জাহাজের ক্যাপ্টেন স্যারকে বলতে বলে, যাতে যুদ্ধজাহাজ চলে যায়। ক্যাপ্টেন স্যার ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীকে বুঝিয়ে দূরে যেতে বলেন। পরবর্তীতে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ আমাদের জাহাজটিকে ফলো করে। জাহাজটি কাছে আসতে চাইলে দস্যুরা বলতে থাকে, হামলা করার চেষ্টা করলে এমভি আবদুল্লাহকে উপকূলে তুলে দেবে। আমাদেরও উপকূলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিতে থাকে।’

নুর উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের জিম্মি করার পর সবার মোবাইল ফোন নিয়ে নেয় তারা। দস্যুরা আমাদের সকলের তালিকা করে মোবাইল ফোন নিয়েছে। আমাদের প্রত্যেককে একটি হলেও মোবাইল ফোন জমা দিতে হয়েছে। যাদের দুটো মোবাইল ফোন ছিল তারা একটা লুকিয়ে রাখে। দস্যুদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পরিবার পরিজনসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি।’

তিনি বলেন, ‘দস্যুরা এক ধরনের কাঠজাতীয় মাদক নিতো। তারা বলেছে এ মাদক নিলে নাকি তিন দিন পর্যন্ত না ঘুমিয়ে থাকা যায়। আমাদের পুরো রমজান কেটেছে জিম্মিদশায়। আমরা জাহাজে সেহরি-ইফতার করেছি। নিয়মিত নামাজ আদায় করেছি। দস্যুরা মুসলিম হলেও তাদের কেউ রোজা রাখেনি, নামাজ পড়তেও দেখিনি। দস্যুরা অত্যন্ত হিংস্র প্রকৃতির ছিল।’

এই নাবিক বলেন, ‘প্রথম দিকে দস্যুরা আমাদের সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ আচরণ করতো। পরে কিছুটা নমনীয় হয়। প্রথম দিকে তারা পেট দেখিয়ে বলতো, মানি মানি। অর্থাৎ তারা টাকার জন্য আমাদের জিম্মি করেছে বলে বোঝাতো। আমরা যখন মুক্তি পাই, সেদিন প্রায় ৬৫ জন দস্যু জাহাজ থেকে নেমে যায়। তারা স্পিডবোট নিয়ে উপকূলে চলে যায়।’

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বাসিন্দা নুর উদ্দিনের পরিবারে রয়েছেন তার মা, স্ত্রী এবং তাদের আড়াই বছরের সন্তান। ২০১৫ সাল থেকে জাহাজে কর্মরত। তিনি বলেন, ‘এত বড় বিপদে কখনো পড়িনি। মনে করেছিলাম বেঁচে ফিরবো না। তবে আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছি এটিই শুকরিয়া। আমি দুবাই বন্দর থেকে বাড়ি ফেরার আবেদন করেছি। আমি মানসিকভাবে অনেক দুর্বল। ভিসা জটিলতার কারণে তা হয়ে ওঠে কিনা বুঝতে পারছি না।’

আপন দেশ/এমআর

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়