ছবি: আপন দেশ
২০১৮ সালে একনেকের সভায় মহান মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন প্রকল্পের অনুমোদন হয়। সে বছরের জুলাই হতে ২০২১ সালের জুন মাসের শেষ হওয়া কথা ছিল নীলফামারীর চার বধ্যভূমি। পেরিয়েছে ছয় বছর। তবুও আলোর মুখ দেখেনি তিন উপজেলার এসব বধ্যভূমি।
প্রকল্পটিতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৪৪ কোটি ৪৪ লক্ষ ১৩ হাজার টাকা। এ অর্থ দিয়ে দেশের ২৮০ বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হওয়ার কথা। প্রতিটি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ডিবিপির জন্য ৮০ ও জমি অধিগ্রহণের জন্য ৪০ লাখ টাকা। এর আওতায় নীলফামারীর ছয় উপজেলার ৯টি বধ্যভূমি সংস্কার ও পুর্ননির্মাণ হওয়ার কথা। ছয়টি বধ্যভূমি বাস্তবায়ন হলেও চার উপজেলায় আলোর মুখ দেখেনি একটিও। আপন দেশ’র এ প্রতিবেদক ডিমলা, ডোমার, কিশোরগঞ্জ ও সদর উপজেলার অবাস্তবায়িত এসব বধ্যভূমি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন।
ডিমলা
উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত শুটিবাড়ী বাজার বধ্যভূমি। বধ্যভূমিটি বাজারের উত্তর পাশে কুমলাই নদীর তীরে অবস্থিত। ২০২০ সালে সংরক্ষণের জন্য আশপাশে বৃহত্তর এলাকাজুড়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। উচ্ছেদের পরে উপজেলা প্রশাসনের তেমন কোন ভূমিকা দেখা যায়নি। বধ্যভূমিটির দক্ষিণে হোটেল থাকায় লোকজন সেখানে নিয়মিত মূত্রত্যাগ করেন। বলা চলে মূত্রত্যাগের স্থানে রূপান্তিত হয়েছে মহান স্বাধীনতার সংগ্রামের নিহত পাঁচজন শহীদ বীরমুক্তিযোদ্ধার চরণভূমি।
জানা গেছে, তদারকির দায়িত্বে রয়েছে জেলা গণপূর্ত বিভাগ। জায়গাটি কুমলাই নদীর তীরে হওয়ায় অনেক নিচু বলে দাবি তাদের। ১৯ শতক জমির ওপর নির্মাণ হওয়ার কথা থাকলেও তা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে বুঝিয়ে দেয়া হয় নির্মাণকারী সংস্থাকে। জায়গাটি মাটি ভরাট ও রিটেইনিং ওয়াল করার জন্য প্রকল্প পরিচালক বরাবর প্রশাসনিক অনুমোদন ও অর্থ বরাদ্দের জন্য পাঠানো হয়েছে। তবে পাঠানো হয়নি জমি সংক্রান্ত সমস্যার বিষয়াদি।
ফজলুল হক নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, এ অঞ্চলের নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধেরর বাস্তব ইতিহাস হিসেবে রয়েছে শুটিবাড়ী বাজারের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর। বিভিন্ন জনের দখল, কুমলাইনদীর মজাপুকুর ও স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের কবর। আমরা চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও সংরক্ষণ করা হোক।
আব্দুল মালেক জানান, শহিদরা গর্বের, অনুপ্রেরণার। তাদের কবর কিছু ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দখলে। অবহেলায়-অযত্নে তাদেরকে অপমান করা হচ্ছে। যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায়না। স্বাধীনাতর স্বাদ তাদের আত্মত্যাগের কারণেই পেয়েছি। সেসব শহীদদের কবর সংরক্ষণ করা দেশের জন্য আবশ্যক দায়িত্ব। কোনো প্রভাবের কাছে কুটি হয়ে যাওয়া লজ্জার।
ডোমার
উপজেলা সদরের চান্দিনাপাড়া গ্রামের পশ্চিম বোড়াগাড়ী বধ্যভূমিটি। বধ্যভূমিটি বর্তমানে মিজানুর রহমান ও আব্দুল মতিন নামে দুজন ব্যক্তির দখলে। সেখানে চাষাবাদ হচ্ছে ফসল। অস্তিত্ব বিলীন হয়ে পড়েছে বধ্যভূমিটি।
কিশোরগঞ্জ
একই অবস্থা কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলি বসুনিয়াপাড়া (নেত্রার বাজার) এলাকার বধ্যভূমিটির। এতে রয়েছে স্থানীয় এক টেলিকম ব্যবসায়ীর বাসস্থান। স্থানীয়রা জানান, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় আশপাশের এলাকার মানুষজনকে এনে জড়ো করা হতো। পরে সারিবদ্ধ করে হত্যার পর মরদেহ রেখে যেত পাক সেনারা।
সদর
সদর উপজেলার শুটিপাড়া এলাকায় অবস্থিত এ বধ্যভূমি। কবরের পরিবর্তে সেখানে রয়েছে লুৎফর রহমানের ব্যক্তি মালিকানায় বাঁশ বাগান। তার দাবি, এখানে কোনো ক্যাম্প বা মানুষ মারা হয়নি। আমার বাপ-দাদারা বলেননি। দাদার সময় থেকে এখানে বাঁশঝাড় এবং এটা আমার দাদা সলেহর বাঁশঝাড় নামেই পরিচিত। স্থানীয় প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের কেউও বলেননি এটা বধ্যভূমি।
তবে স্থানীয় আজিজুল ইসলাম জানান, শুটিপাড়া বধ্যভূমিতে তার বাবাকে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছিল। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, স্টেশন পাড়ার বোচা বাবুসহ আরও কয়েকজনকে এনে এ বাঁশঝাড়ের এখানে মেরে ফেলা হয়। আমার বাবাকে এনে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছিল। যখন মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে এখানে গুলি করেছিল। তখন পাকবাহিনী টেক্সটাইল হয়ে সৈয়দপুর চলে যায়। ফলে আমার বাবা বেঁচে গেছিল। কিন্তু এখন এটা লুৎফরের বাঁশঝাড়। সবাই সলেহর বাঁশঝাড় নামেই চেনে। এটা সংরক্ষণ করা হলে সবাই যায়গাটা চিনত, সম্মান করত।
নীলফামারী গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সাকিউজ্জামান বলেন, জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে যে জমি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে শুটিবাড়ী বাজারে যে জমি দেয়া হয়েছে, তা নদী শ্রেণিতে পড়েছে। বধ্যভূমির উত্তরে বড় পুকুর রয়েছে। আমাদের মোট বাজেটের ৬৩ লাখ টাকা বেশি ব্যয় দাঁড়াবে। বাহাগিলি ও সুটিপাড়া যে বধ্যভূমি রয়েছে তা ব্যক্তি মালিকানা জমি। এ তিনটি বধ্যভূমির জন্য জেলা প্রশাসক ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তারা উদ্যোগ নিলেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
ডোমারের পশ্চিম বোড়াগাড়ী বধ্যভূমির জায়গা অধিগ্রহণ প্রায় শেষ। দ্রুত এটি বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
আপন দেশ/এসএমএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।