Apan Desh | আপন দেশ

মৃত্যুর ১১ বছর পর ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ, এলো নোটিশ

জয়পুরহাট প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১২:৫৭, ১৫ অক্টোবর ২০২২

মৃত্যুর ১১ বছর পর ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ, এলো নোটিশ

ফাইল ছবি

জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের পাঁচুইল গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন পরেশ চন্দ্র। তিনি মারা গেছেন ১৯৯৪ সালে। মারা যাওয়ার ১১ বছর পর আবার জীবিত হয়ে জয়পুরহাট জেলার সোনালী ব্যাংক লিঃ ক্ষেতলাল শাখায় ঋণ গ্রহন করেন তিনি।

মৃত পরেশ চন্দ্রের বাবার নাম মৃত কৈলাশ চন্দ্র। মৃত পরেশ চন্দ্র দুই ছেলে দুই মেয়ের জনক। বড় ছেলে নরেশ চন্দ্র, ছোট ছেলে পলাশ চন্দ্র, মেয়ে অতীতা বালা ও গৌরি বালা। মৃত পরেশ চন্দ্রের স্ত্রী মাখন বালা জীবিত রয়েছেন।

তবে তিনি জীবিত হয়ে নিজের বাড়িতে যাননি আবার পরিবারের সদস্য, আত্মীয় স্বজন ও গ্রামবাসীরাও কেউ তাকে দেখেননি। তিনি শুধু গিয়েছিলেন সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল শাখায়। ব্যাংকের এ শাখায় ঋণ ডকুমেন্টে স্বাক্ষর করে তিনি দশ হাজার টাকা ঋণ গ্রহন করেছিলেন। শুধু ব্যাংকটির কর্মকর্তারা ছাড়া অন্য কেউ তাকে দেখেননি। ব্যাংকে রক্ষিত ঋণ ডকুমেন্ট এ সাক্ষ্য দিচ্ছে।

সম্প্রতি সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ক্ষেতলাল শাখা থেকে ২৮ বছর আগে পরলোকগমনকারী শ্রী পরেশ চন্দ্রের নামে দশ হাজার টাকা এমসিডি ঋণ পরিশোধের নোটিশ খামে ভরে পাঠানো হয়। ডাকযোগে পাঠানো ব্যাংকের রেজিষ্ট্রিকৃত চিঠিটি মৃত পরেশ চন্দ্রের বড় ছেলে নরেশ চন্দ্র গ্রহন করেন। চিঠি খুলে তিনি তাঁর বাবার নামে ব্যাংকের দশ হাজার টাকার এমসিডি ঋণ পরিশোধের নোটিশ দেখতে পান।

নোটিশে এক নজর চোখ বলিয়ে ভেবেছিলেন জীবিত থাকতে হয়তো বাবা ঋণ নিয়েছিলেন। এতদিন পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঋণ পরিশোধের নোটিশ দিয়েছে। নোটিশের নিচের অংশ গিয়ে তার বাবার ঋণ গ্রহনের তারিখ দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়। নোটিশে তার বাবার ঋণ গ্রহনের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর।

নোটশি দেখে তিনি তখন ছুটে যান সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখায়। ব্যাংকের কর্মকর্তাও তার বাবার ঋণের নথিপত্র ঘেঁটে ঋণ গ্রহনের তারিখ সঠিক থাকার কথা তাকে জানান।

তখন নরেশ চন্দ্র তার বাবা পরেশ চন্দ্র ২৮ বছর আগে অথাৎ ১৯৯৪ সালে মারা গেছেন বলে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জানান। ব্যাংকের কর্মকর্তা তার কথার প্রতিত্তোরে তাকে বলেন, আপনার বাবা শ্রী পরেশ চন্দ্র ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবরে ঋণের নথিপত্রে স্বাক্ষর দিয়ে ঋণ গ্রহন করেছেন। ঋণের নথিতে আপনার বাবার নাগরিত্ব সনদ, ছবি-জমির কাগজপত্র স্বাক্ষর সবই আছে।

ব্যাংকে রক্ষিত ৩২৮ নম্বর এমসিডি ঋণের নথিপত্রে পরেশ চন্দ্রের নাম রয়েছে। তিনি ছবি-নাগরিকত্ব সনদ, জমির কাগজ দিয়ে ঋণ ডকুমেন্টে স্বাক্ষর দিয়ে দশ হাজার ঋণ গ্রহন করেছেন। ঋণ পরিশোধের পাঠানো নোটিশের সঙ্গে তার মিল রয়েছে।

স্থানীয় আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে নরেশের কথার সত্যতাট মিলল রয়েছে। আলমপুর ইউনিয়নের ১৯৮৭ সালের ফেরুয়ারি মাসে মৃত্যু রেজিষ্টারে ওই মৃত্যু রেজিষ্টারের ৩৮ নম্বর পাতার ৪৩ নম্বর সিরিয়ালে পাঁচুল গ্রামের শ্রী পরেশ চন্দ্রের নাম রয়েছে। তার মৃত্যুর তারিখ ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে বুকের ব্যথার কথা উল্লেখ রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা, ইউপি চেয়ারম্যান, ওর্য়াডের ইউপি সদস্যরাও জানালেন ১৯৯৪ সালের ওই তারিখে পরেশ চন্দ্রের পরলোক গমনের কথা। আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ২০২১ সালের ৯ মার্চ মাসে নরেশ চন্দ্রকে তার বাবার মৃত্যুর সনদ দেওয়া হয়েছে। তাতেও তার মৃত্যুর তারিখ ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন উল্লেখ আছে।

নরেশ চন্দ্র বলেন, দশ হাজার টাকা বড় কথা নয়। আমার বাবা মৃত্যুর ১১ বছর পর কিভাবে ব্যাংকে গিয়ে ঋণ গ্রহন করলেন তাতে আমরা আশ্চর্য হয়েছি। আমার বাবা মৃত পরেশ চন্দের ১২-১৪ বিঘা জমি রয়েছে। আমার বাবা জীবিত থাকা অবস্থায়ও কোন ঋণ নেননি বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। আমরা আগে কখনও আমার বাবার নামে থাকা ঋণ পরিশোধের নোটিশ পাইনি।

আলমপুর ইউপি সদস্য আব্দুল হালিম জানান, আমার ওর্য়াডের পাঁচুইল গ্রামের শ্রী পরেশ চন্দ্র ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন মারা গেছেন। সেই ব্যক্তি ২০০৫ সালে সোনালী ব্যাংক থেকে কিভাবে দশ হাজার টাকা নিলেন তা জেনে হতবাক হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের ক্ষেতলাল শাখায় সেই সময় কৃষি ও এমসিডি ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছিল দাবি করে তিনি জানান, পাঁচুইল গ্রামের কার্তিক চন্দ্রের ছেলে শ্রী নরেশ চন্দ্রের নামেও ১৫ হাজার টাকার ঋণ পরিশোধে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশে তার ঋণ গ্রহনের তারিখ ২০০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দেখানো হয়েছে।

আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আনোয়ারুজ্জামান তালুকদার নাদিম জানান, পাঁচুইল গ্রামের পরেশ চন্দ্রের মৃত্যুর তারিখ ইউপি কার্যালয়ের মৃত্যু রেজিষ্টারে উল্লেখ রয়েছে। ইউপি কার্যালয় থেকে শ্রী পরেশ চন্দ্রের মৃত্যুর সনদ দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুর ১১ বছর পর কিভাবে ব্যাংক ঋণ পেলেন তা জেনে খুবই আশ্চর্য হয়েছি। ক্ষেতলাল সোনালী ব্যাংকে এক সময় কৃষি ও এমসিডি ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছিল। তখন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি।

সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখার একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০০৪ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রায় চার কোটি টাকার কৃষি, এমসিডি ঋণ দেওয়া হয়েছিল। এরই ৮০ শতাংশ অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হয়েছে। সেই সময়কার ব্যাংকের কয়েক জন কর্মকর্তার ওপর এসব ঋণের দায় বর্তানো হয়েছে। এরমধ্য কয়েক জন কর্মকর্তা অবসরে গেছেন। ঋণ অনাদায়ী থাকায় তাঁদের কারও ১৬ লাখ, ৯ লাখ, ২৭ লাখসহ বিভিন্ন অংকের টাকা ব্যাংক কেটে নেওয়া হয়েছে।

সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখার ব্যবস্থাপক সিনিয়র প্রিন্সপাল কর্মকর্তা মোঃ আহসান হাবিব জানান, ব্যাংকে রক্ষিত ঋণ ডকুমেন্টে দেখা গেছে, উপজেলার পাঁচুইল গ্রামের শ্রী পরেশ চন্দ্র ২০০৫ সালে কাগজপত্র ও স্বাক্ষর দিয়ে ব্যাংক ঋণ নিয়েছেন। ঋণটি পরিশোধ হয়নি। এখন ঋণটি শ্রেণিকৃত হয়েছে। একারণে ঋণের আসল টাকা পরিশোধের জন্য নোটিশ করা হয়েছে।

মারা যাওয়া ব্যাক্তি কিভাবে ঋণ নিলেন এমন প্রশ্নে তিনি জানান, তখন এখানে শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলাম না। একারণে সেটি আমার জানার কথাও নয়।

আপন দেশ ডটকম / এমএবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়