আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস টাঙ্গাইল।
টাঙ্গাইল আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে গ্রাহক হয়রানির সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে অবৈধ চ্যানেল ফি এবং সক্রিয় দালাল চক্র। এতে সাধারণ মানুষদের কষ্ট বেড়েছে। বিশেষত যারা পাসপোর্ট করতে এসে নিয়ম-কানুন মানতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন।
যুবক আবুল হাসেম দুলাল। তিনি টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী থেকে পাসপোর্টের আবেদন জমা দিতে এসেছিলেন। হাসেম মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ফি জমা দিয়ে অনলাইনে আবেদন ফর্ম পূর্ণ করেন। তবে পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহকারী জোবায়ের আহমেদ তাকে জানিয়ে বলেন, ‘বিয়ে করেনি’ মর্মে চেয়ারম্যানের সনদ না আনলে আবেদন ফর্ম গ্রহণ করা হবে না। বিষয়টি তিনি জানতে পেরে হতাশ হয়ে বসে পড়েন।
একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে তাকে একজন দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। সে দালাল জানান, ফরম সরাসরি জমা নেয়া হবে না। ১৫০০ টাকা দিলে আমি জমা দেয়ার ব্যবস্থা করব।
এভাবেই টাঙ্গাইল পাসপোর্ট অফিসে আবেদনকারীদের দুর্দশা চলছে। একদিকে সরকারি ফি, অন্যদিকে চ্যানেল ফি—এ ধরনের সিস্টেমে যাদের পকেটে অতিরিক্ত টাকা নেই, তারা চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন।
টাঙ্গাইল পাসপোর্ট অফিসে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সূত্র অনুযায়ী, সিন্ডিকেটের মূল হোতা অফিস সহকারী কাম মূদ্রাক্ষরিক জোবায়ের আহমেদ এবং পরিচ্ছন্ন কর্মী মাসুম হরিজন। তাদের সাথে কিছু আনসার সদস্য এবং ১৫-২০ জন বহিরাগত দালাল জড়িত। নিয়মিতভাবে প্রতি পাসপোর্টের সরকারি ফি’র পাশাপাশি ১ হাজার ১০০ টাকা উৎকোচ গ্রহণ করা হয়।
পাসপোর্ট জমা দিতে আসা গ্রাহকরা অভিযোগ করেন, অফিসের কাজ একদমই ধীর গতিতে চলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও আবেদন ফরম জমা দিতে বাধাপ্রাপ্ত হন। কিন্তু যাদের সঙ্গে দালালরা আছে, তাদের কোনো সমস্যা হয় না। তারা মাত্র ১৫০০ টাকা দিয়ে মুহূর্তে কাজ শেষ করে চলে যেতে পারেন। এ চ্যানেল ফি’র নামে প্রতি পাসপোর্টে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১ হাজার ১০০ টাকা সরকারি ফি, বাকি টাকা চলে যাচ্ছে দালালদের পকেটে।
অফিসের কর্মকর্তা এবং দালালদের মধ্যে একটি অপ্রকাশিত চুক্তি আছে। যেখানে তারা ‘চ্যানেল ফি’ ভাগ করে নেয়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দালালদের চাপ থাকে। আর গ্রাহকরা অতিরিক্ত টাকা ছাড়া পাসপোর্ট আবেদন করতে পারেন না।
পাসপোর্ট অফিসে কিছু অভিযোগ এসেছে যে, অসুস্থ রোগীদের জন্য আলাদা সেবা থাকার কথা হলেও তা একেবারেই উপেক্ষিত হচ্ছে। অসুস্থ ব্যক্তি রাশিদুল বলেন, পাসপোর্ট নিতে অফিসে এসে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এত অসুস্থ হওয়ার পরও আমি তেমন কোনো সুবিধা পাইনি। শুনেছিলাম সরকারি অফিসে অসুস্থদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু এখানে তেমন কিছু নেই।
পাসপোর্ট অফিসের দালাল চক্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তারা স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও কিছু আনসার সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে পাসপোর্ট কাজ পরিচালনা করছেন। তাদের নিয়ন্ত্রণেই পাসপোর্ট অফিস চলে। গাঁ-গঞ্জের সাধারণ মানুষের পক্ষে পাসপোর্ট আবেদন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাসপোর্ট অফিসে মাষ্টাররোলে কর্মরত মাসুম হরিজন বলেন, তিনি গ্রাহকদের পাসপোর্ট ডেলিভারি করেন। অফিস সহকারী জোবায়ের আহমেদের নির্দেশে অন্যান্য স্টাফ ও আনসার সদস্যরা ফরম জমা নেন।
চ্যানেল ফি সম্পর্কে তিনি বলেন, আগে এমন ব্যবস্থা ছিল, এখন নেই। তবে ভিআইপিদের পাসপোর্টে বখশিস নেয়া হয়। এতে তার কোনো দোষ দেখেন না।
এ ব্যাপারে অফিস সহকারী কাম মূদ্রাক্ষরিক জোবায়ের আহমেদ বলেন, তিনি অফিসের উপ-পরিচালক বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ অনুযায়ী অফিস পরিচালনা করেন। চ্যানেল ফি বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর সরকার কিছুদিন পাসপোর্ট অফিসে অভিযান চালিয়েছিল। তবে পরিস্থিতি তেমন পরিবর্তিত হয়নি। দালালরা এখনও সক্রিয়। অফিসের কর্মচারীদেরও তারা ভয়ভীতি দেখিয়ে চলেছে।
এক সরকারি কর্মকর্তা জানান, দালালদের কারণে আমাদেরও ঝামেলায় পড়তে হয়। যখনই দালালদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে যাই, তারা আমাদেরকে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়।
টাঙ্গাইল আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক জেবুন্নাহার পারভীন জানান, এ ধরনের সমস্যাগুলোর সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়ত লড়াই করছি। তবে দালালদের বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু বলতে পারি না। কারণ তারা আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত। আমরা চেষ্টা করছি যতটুকু সম্ভব শৃঙ্খলা ফেরাতে।
তিনি আরও জানান, পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন প্রায় ৪৫০-৫০০ জন আবেদন জমা দেন। তবে তাদের সমস্যাগুলো যথাযথভাবে খতিয়ে দেখে দ্রুত সমাধান দেয়ার চেষ্টা করছি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সভাপতি বাদল মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে, অধিকাংশ জায়গায় দুর্নীতি কঠিন হয়ে পড়েছে। পাসপোর্ট অফিসের মতো জায়গায় এ দুর্নীতি সবচেয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে।
তিনি আরও বলেন, যতদিন না দুর্নীতি রোধের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে, ততদিন সাধারণ জনগণের কষ্ট অব্যাহত থাকবে।
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।