
ছবি : আপন দেশ
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও ইফাদের আর্থিক সহযোগিতায় আরএমটিপির ‘উচ্চমূল্যের ফল-ফসলের জাত সম্প্রসারণ ও বাজারজাতকরণ’ শীর্ষক ভ্যালু চেইন উপপ্রকল্পের আওতায় লোকাটের চাষ শুরু করেছেন বেসরকারি সংস্থা ইকো-সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)। ২০২৩ সালের ১০ নভেম্বর তেঁতুলিয়া উপজেলার ৩০ জন উদ্যোক্তাদের মাঝে ৪৮৫টি লোকাট গাছের চারা বিতরণ করে সংস্থাটি।
পরীক্ষামূলকভাবে হলেও উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে প্রথমবারের মতো আবাদ হচ্ছে ভিনদেশি ফল এ লোকাট। এসব গাছগুলোর মধ্যে কিছু গাছে আসতে শুরু করেছে ফল। প্রান্তিক উপজেলার ৩০ জন উদ্যোক্তারা উচ্চমূল্যের এই বিদেশি ফল চাষ শুরু করে কৃষিতে নতুন আবাদ যুক্ত হয়েছে।
লোকাট চাষের ৩০ উদ্যোক্তার একজন রইছুন আক্তার (৩০)। এ উদ্যোক্তার বাড়ি তেঁতুলিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের শারিয়ালজোত গ্রামে। এবার তার বাগানের বেশ কিছু গাছে ফল ধরেছে। এ কৃষাণী জানায়, বছরে দুইবার ফলন দেয় লোকাট। গত বছরের জুন-জুলাই মাসে কয়েকটি গাছে ফুল এলেও তা ঝরে যায়। প্রথম গাছ লাগানোর পরের বছর গাছে দুটি ফল ধরে। এবার বাগানে বেশ কয়েকটি গাছে ফল ধরেছে। ফলগুলো অনেক সুস্বাদু এবং রং খুব সুন্দর। পাকলে হলুদ বা কমলা রং ধারণ করে।
বেসরকারি সংস্থা ইএসডিও জানায়, ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো জেলার তেঁতুলিয়ার একটি সীমান্তঘেষা দর্জিপাড়া গ্রামে শীতপ্রধান দেশের উচ্চমূল্যের ফুল আবাদ করতে উদ্যোগ গ্রহণ করে। সে বছর প্রান্তিক ৮ জন নারী কৃষাণীদের মাধ্যমে নেদারল্যান্ড থেকে সৌন্দর্য ছড়ানো ফুল টিউলিপ ফুটিয়ে চমকে দেন। টিউলিপ ঘিরে পর্যটন শিল্পে যুক্ত হয় নতুনমাত্রা। উত্তরের পর্যটন শিল্প অঞ্চলে ইকোট্যুরিজম গড়ে তুলতে টিউলিপের পাশাপাশি বিদেশি বিভিন্ন উচ্চ মূল্যের ফুল ও ফল আবাদের অন্যতম উদ্যোগ লোকাট চাষ।
ইএসডিও আরও জানায়, পুষ্টি নিরাপত্তায় খাদ্য তালিকায় ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের জলবায়ু ও আবহাওয়া আধা উষ্ণ প্রকৃতির হলেও সাব ট্রপিক্যাল অঞ্চলের অনেক উচ্চমূল্যের ফল-ফসল যেমন লোকাট, পার্সিমন, কমলা, রাম্বুটান, কফির চাষ খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। বিশ্বের মোট উৎপাদিত প্রায় ১০০ মিলিয়ন টন ট্রপিক্যাল ফলের প্রায় ৫০% এশিয়ায় উৎপাদিত হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন বিভিন্ন ট্রপিকাল ফল উৎপাদন ও রপ্তানিতে এগিয়ে রয়েছে। অথচ বাংলাদেশের জলবায়ু ও মাটির ধরন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও এক্ষেত্রে উচ্চমূল্যের এসব ফল চাষ তেমন লক্ষ্য করা যায় না। এ অঞ্চলে ইকোট্যুরিজম গড়ে তুলতে গত বছর ১১ সেপ্টেম্বর জেলার তেঁতুলিয়া ও পঞ্চগড় সদর উপজেলার ২৫০ জন উপকারভোগীদের মাঝে কফি, বীজবিহীন লিচু, পামেলো, পার্সিমন, আনারস (এমডি ২), কমলা (দার্জিলিং), গোলমরিচ ও দারুচিনির ১৫ হাজার গাছের চারা বিতরণ করা হয়।
লোকাট সম্পর্কে জানা যায়, লোকাট একটি চির সবুজ গাছ। গ্রীস্মমন্ডলীয় ফল। এটি দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষত বাংলাদেশ, পাকিস্থান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মতো অঞ্চলে প্রাকৃতিভাবে গাছটি খুব ভালভাবে জন্মায়। এশিয়ায় ৮শটিরও বেশি লোকাটের জাত রয়েছে। স্ব-উর্বর রূপের মধ্যে রয়েছে 'গোল্ড নাগেট' এবং 'মোগি' জাত। লোকাট উপ-ক্রান্ত্রীয় থেকে হালকা নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে জন্মানো সহজ। যেখানে এটি প্রায়শই মূলত একটি শোভাময় উদ্ভিদ হিসাবে জন্মায়। বিশেষ করে এর মিষ্টি-সুগন্ধযুক্ত ফুলের জন্য এবং দ্বিতীয়ত সুস্বাদু ফলের জন্য। সাহসী টেক্সচারযুক্ত পাতাগুলি বাগানে একটি গ্রীস্মমন্ডলীয় চেহারা যোগ করে, যা অন্যান্য অনেক গাছের সাথে ভালভাবে বৈপরীত্যপূর্ণ।
বিভিন্ন দেশ বাণিজ্যিকভাবে লোকাট চাষ করে, তবে চীন ও জাপানকে প্রধান উৎপাদক বলা হয়ে থাকে। ফলটিতে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মজ্জা থাকে এবং ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বীজ থাকে। বীজের আকারের কারণে বর্জ্যের অনুপাত ৩০% বা তার বেশি। সারা বছরই ফল দেয়ায় গাছটি ছাদে কিংবা মাঠে বাগান করে চাষাবাদ করা যায়। পাতার রঙ গাঢ় সবুজ এবং এর শিরাগুলি দৃশ্যমান থাকে। দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। ফলের আকার গোলাকার বা ডিম্বাকৃতি হয়ে থাকে। পাকা অবস্থায় উজ্জ্বল হলুদ বা কমলা রঙের হয়। ফলটি মিষ্টি ও হালকা টক স্বাদের। গাছটি ৩৫ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। একটি পূর্ণবয়স্ক গাছের উচ্চতা সাত থেকে আট মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ফলটিতে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর। এটি সাধারণত সরাসরি খাওয়া হয়। জ্যাম, জেলি এবং ডেজার্ট তৈরিতে ব্যবহৃত হয় লোকাট। লোকাট গাছ সুনিষ্কাশিত মাটিতে এবং উষ্ণ আবহাওয়ায় ভালোভাবে জন্মায়।
লোকাট রন্ধন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ফলটিতে উচ্চ পরিমাণে চিনি, অ্যাসিড এবং পেকটিন থাকে। এটি একটি তাজা ফল হিসেবে খাওয়া হয়। তাজা ফলের সালাদ বা ফলের কাপে অন্যান্য ফলের সঙ্গে ভালোভাবে মিশে যায়। ফলটি সাধারণত জ্যাম, জেলি এবং চাটনি তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। প্রায়শই হালকা সিরাপে পোচ করে পরিবেশন করা যায়। শক্ত, সামান্য অপরিণত ফল পাই বা টার্ট তৈরির জন্য সবচেয়ে ভালো। যখন ফলগুলি নরম এবং কমলা হলে সবচেয়ে মিষ্টি হয়। ফলটি কখনও কখনও ক্যানড বা মিষ্টান্নে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
এছাড়াও অন্যান্যভাবেও ব্যবহার হয়ে থাকে লোকাটের। পশুখাদ্য তৈরি এবং বমি ও তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ওষুধ তৈরি হয়ে থাকে। লোকাটের কাঠ নাশপাতি কাঠের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রুলার/অন্যান্য লেখার যন্ত্র তৈরিতে ভালো কাজ করে। ইউরোপে লোকাটের ফুল সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় বলে জানা যায়। লোকাটের গুড়ো পাতা ডায়রিয়া, বিষন্নতা এবং অ্যালকোহলযুক্ত নেশার চিকিৎসাতেও ব্যবহৃত হয়।
ইএসডিওর প্রজেক্ট ম্যানেজার কল্যাণ মহন্ত জানান, লোকাট গাছে ফুল আসার পর থেকে ফল পরিপক্ক হতে তিন মাস সময় লাগে। তারা আশা করছেন, যে ফলগুলো ধরেছে, তা এপ্রিল-মে মাসে খাওয়ার উপযোগী হবে।
ইএসডিওর হেড অব ইনক্লুসিভ মাইক্রোফিন্যান্স ও ফোকাল পারসন মো আইনুল হক বলেন, এসব বিদেশি ফলের চারা থাইল্যান্ড থেকে আনা হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে চাষিরা অর্থনৈতিকভাবে যেমন স্বাবলম্বী হবেন, তেমনি তেঁতুলিয়ায় ইকো ট্যুরিজমের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তামান্না ফেরদৌস বলেন, লোকাট মূলত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বেশি আবাদ হয়ে থাকে। উচ্চমূল্যের ফল। বছরে দুই-তিনবার ফল দিয়ে থাকে। তেঁতুলিয়ায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইএসডিও উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে আবাদ করছে জেনেছি।
আপন দেশ/জেডআই
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।