ছবি: আপন দেশ
কর আপিল ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন সদস্য আ. জা. মু. জিয়াউল হক ও তার স্ত্রী মোর্শেদা কুদ্দুসের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত বুধবার কমিশন মামলা দু’টির অনুমোদন দেয়। বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) দায়ের করা হয় মামলা। এজাহারে রাজস্ব কর্মকর্তা জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে ৫ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ৫১৮ টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগ আনা হয়েছে। তার স্ত্রী মোর্শেদা কুদ্দুসের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে ২২ কোটি ২০ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ।
দুদকের উপ-পরিচালক সেলিনা আখতার বাদী হয়ে এ মামলা করেন। এছাড়া জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধার সনদ জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে পৃথক অনুসন্ধানেরও অনুমোদন দিয়েছে কমিশন।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাজস্ব কর্মকর্তা জিয়াউল হক ১৯৯১ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চাকরিতে যোগ দেন। ২০১৯ সালে তিনি অবসরোত্তর ছুটিতে যান। এ সময়ের মধ্যে তার আয়কর ফাইলে প্রদর্শিত আয়-ব্যয়ের হিসেব থেকে ৫ কোটি ৬১ লাখ ৬৭ হাজার টাকার সম্পদ অতিরিক্ত পাওয়া যায়।
দুদক অনুসন্ধানে মিলেছে, স্বামী জিয়াউল হকের চেয়ে স্ত্রী মোর্শেদা কুদ্দুসের অবৈধ সম্পদের পরিমাণ চার গুণ বেশি। আয়কর নথিতে মোর্শেদা কুদ্দুস রাজধানীর বড় মগবাজারের মৃত্যুপথযাত্রী ভাইয়ের কাছ থেকে ৫৩ শতাংশ আয়তনের প্লট হেবামূলে পেয়েছেন-মর্মে উল্লেখ করেন। কিন্তু দুদকে হেবামূলে সম্পদ প্রাপ্তির পরিষ্কার কোনো রেকর্ডপত্র দাখিল করতে পারেননি তিনি।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, জিয়াউল হক তার অবৈধ সম্পদ আড়াল করতে অসুস্থ স্ত্রীর ভাইয়ের নামে প্রথমে প্লটটির দলিল করেন। যারা সমুদয় টাকা পরিশোধ করেন জিয়াউল হক। পরে ভাইয়ের কাছ থেকে পৃথক দু’টি হেবা দলিল করে মোর্শেদা কুদ্দুসের নামে আনেন। যার দলিল মূল্যই ২২ কোটি ২০ হাজার টাকা। প্রকৃত মূল্য কয়েক গুণ বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। মামলার যথাযথ তদন্ত হলে এটিও উদঘাটন করা সম্ভব বলে মতামত দেয়া হয়েছে অনুসন্ধান প্রতিবেদনে।
এজাহারে জিয়াউল হকের স্থাবর সম্পত্তির অংশ বিশেষের বিবরণ রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম দক্ষিণ কাট্টলির সৈকত নিবাস আবাসন প্রকল্পে ১০ কাঠার প্লট, রাজউক থেকে প্রাপ্ত উত্তরা তৃতীয় ফেইজে সেক্টর-১৭, রোড-৩, প্লট-১২’তে ৩ কাঠা প্লট। গাজীপুর কালিগঞ্জ থানাধীন কেটুন মৌজায় ২৮ দশমিক ২৯ শতাংশের প্লট, উত্তরা আবাসিক এলাকার সেক্টর-১০, রোড-৩, প্লট-৩ এ রয়েছে ৫ কাঠার প্লট।
আরও পড়ুন>> এনবিআর কর্মকর্তা জিয়াউল দম্পতি দুদকের জালে
রাজধানীর ৬৪৬, বড় মগবাজারে ৫৪ শতাংশের বহুবতল ভবন। জিয়াউল হকের দাবি, এটি ২০১৮ সালের ৯ জুলাই স্ত্রী মোর্শেদা কুদ্দুসের কাছ থেকে হেবা দলিলের মাধ্যমে পেয়েছেন। তাই এটির মূল্য সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেননি। নিজ এলাকা ফেনীর ছাগলনাইয়ার উত্তর মন্দিয়া গ্রামে নিয়েছেন ৪০ শতাংশ জমি। যার মূল্য তিনি ১৫ হাজার টাকা বলে দাবি করেছেন। এ জমিটি রেজিস্ট্রি হয়েছে ১৯৯৭ সালের ১ এপ্রিল। এক সপ্তাহের মাথায় ৭ এপ্রিল একই মৌজায় পৃথক দাগে আরও ৫৩ শতাংশ জমি কিনেছেন। যার মূল্যও দেখিয়েছেন ১৫ হাজার টাকা।
রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন বনলতা আবাসিক এলাকায় কিনেছেন ৩ দশমিক ৪৩ কাঠার প্লট। বলাবাহুল্য, সবগুলো প্লটেই এখন বহুতল ভবন। জিয়াউল হক তার সম্পদ বিবরণীতে নিজ নামে অর্জিত অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৩৭ হাজার ১৭৫ টাকা। পরে আবার এ অর্থ থেকে ৩ কোটি ৩১ লাখ ৫২ হাজার ১৭৬ টাকা বিনিয়োগ দেখিয়েছেন।
সম্পদ বিবরণীতে স্ত্রী মোর্শেদা কুদ্দুসকে উপস্থাপন করেছেন নিজের চেয়েও ধনবতী হিসেবে। রাজধানীর ১৪৭/বি-৬ গ্রীন রোড, পান্থপথে ৫ কাঠার ওপর বহুতল ভবন। রেজিস্ট্রি খরচসহ প্লটটির মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ১৪ লাখ ৫০ হাজার। ভবন নির্মাণ ব্যয় দেখিয়েছেন ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
মিরপুর পাইকপাড়ায় রোড-১৪, বাড়ি-৭৪সি-তে ৩৪০০ বর্গ ফুটের তিনটি ফ্ল্যাট। এগুলোর মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ৩৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। রাজধানীর ধানমন্ডিতে রোড-১০, ২৫ নং বাড়ি কিনেছেন সাড়ে ১৮০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। এটির মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ২০ লাখ ২৩ হাজার টাকা। গুলশান-২ নম্বরে রোড-১০৪, বাড়ি-৬, ফ্ল্যাট- ৩০১ এ ২৬৮০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট।
মোর্শেদা কুদ্দুস এসি মায়ের কাছ থেকে হেবা দলিলমূলে প্রাপ্ত হয়েছেন বিধায় মূল্য উল্লেখ করেননি। ফেনীস্থ কুমিল্লা বাসস্ট্যান্ডের ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ প্লটও দেখিয়েছেন ভাইয়ের কাছ থেকে দান হিসেবে প্রাপ্ত বলে দাবি করেন। এর মূল্যও তাই উল্লেখ করেননি।
বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন মূল্যবান এটি প্লটেও রয়েছে ভবন। তবে নির্মাণ ব্যয় উল্লেখ করেননি। ফেনীর মিজান রোডে ৪৪৬ নম্বরে রয়েছে ১১তলা ভবন। এ সম্পত্তিও উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন বিধায় মূল্য উল্লেখ করেননি। মোর্শেদা কুদ্দুসের অর্জিত অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ২ কোটি ৮৯ লাখ ৩৪ হাজার ৯৭০ টাকার বলে দাবি করেন।
দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ঢাকার কর আপিল ট্রাইব্যুনালের সদস্য আ. জা. মু. জিয়াউল হক মোট ৬ কোটি ৩১ লাখ ৫২ হাজার ৫৪৩ টাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। একইসঙ্গে স্ত্রী মোর্শেদা কুদ্দুস এক কোটি চার লাখ ২৩ হাজার ৫৩০ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ করেন। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিভিন্ন আর্থিক খাতে বিনিয়োগ করেছেন। যা দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬ (২), ২৭(১) এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
জিয়াউল হক নিজেকে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা‘ বলে দাবি করেন। এর সপক্ষে তিনি মুক্তিযোদ্ধা সনদ দাখিল করেন। কিন্তু এ সনদ আদৌ সঠিক কি না সেটি অনুসন্ধানের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে অনুসন্ধান প্রতিবেদনে।
আপন দেশ/এবি/এসএমএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।