চৌধুরী নাফিজ সরাফাত
জবানবন্দি নিতে পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতকে ডেকেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় দুদকে হাজির হতে চিঠি দেয়া হয়েছে। মানিলণ্ডারিং ও অর্থ লোপাটের মামলায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
গত ১৬ অক্টোবর রাজধানীতে তার তিনটি ঠিকানায় নোটিসটি পাঠানো হয়। আসামি নাফিস সরাফতের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান মাসুদুর রহমান এ নোটিস পাঠান। তিনি দুদকের উপপরিচালক। নোটিসে তিনি উল্লেখ করেন, সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে আপনার বক্তব্য শ্রবণ ও গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক, আর্থিক খাত ও শেয়ারবাজার বারবার প্রভাব খাটানোর অভিযোগ নাফিজ সরাফতের বিরুদ্ধে। সরকার পতনের পর তার অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
দুদক সূত্র জানায়, নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু হয় গত ১০ জুন। ব্যাংক দখল, ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ঋণ জালিয়াতি ও আর্থিক অনিয়মের অনেক অভিযোগ রয়েছে নাফিজের বিরুদ্ধে। ব্যাংকসহ বিভিন্ন সেক্টর থেকে আত্মসাৎ, অর্থ পাচার করে কানাডায় তিনি বাড়ি করেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। গত সরকারের সময় তিনি ছিলেন অপ্রতিরোদ্ধ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হলেও তিনি পলাতক।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, ছাগলকাণ্ডে আলোচিত এনবিআরের সাবেক সদস্য মতিউর রহমান ও চৌধুরী নাফিজ সরাফাত সিন্ডিকেট করে দুর্নীতি করতেন। ফারমার্স ব্যাংকে নাফিজ সরাফাতের চেয়ারম্যান হওয়ার পেছনে বেনজীর আহমেদ ভূমিকা রেখেছেন। ওই সময় বেনজীর র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন।
ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকার সময় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ব্যাংকের গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন। পরে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন নাফিজ সরাফাত। এর পর থেকেই নাফিজ প্রতারণা, জালিয়াতি করে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকের টাকা লোপাট করেন। ব্যক্তিগত ও স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে নাফিজ সরাফাত গত ৩১ জানুয়ারি পদত্যাগ করেছেন।
নাফিজ সরাফাতের দুর্নীতির খণ্ডচিত্র
দুদকের অনুসন্ধানে তথ্য পাওয়া গেছে, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা ছিল। তারপরও শীর্ষ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান গ্রাম-বাংলা ফার্টিলাইজার কোম্পানিকে ৪০ কোটি টাকা ঋণ দেয় নাফিজ সরাফাত ও তার সহযোগীরা। বিলুপ্ত ফারমার্স ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে জেসিকা ইন্টারন্যাশনালের অনুকূলে ৬০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করে। তারা ওই টাকা আত্মসাৎ করেছে। ১৫০ কোটি টাকা পদ্মা ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান পদ্মা সিকিউরিটিজের মাধ্যমে নাফিজ সরাফাতের ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণাধীন স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরিয়েনেওয়া হয়। ফ্লোরা সফটওয়ার লিমিটেড নামে কোম্পানি থেকে ব্যাংকের জন্য ১৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকার সফটওয়্যার কেনার ক্ষেত্রে নাফিজ সরাফাত কোম্পানির কাছ থেকে ৮ কোটি টাকা ঘুষ নেন। এক দিনেই কোম্পানির মালিকের চেক ভাঙিয়ে ব্যাংকের ভল্ট থেকে ৫ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়। পদ্মা ব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান পদ্মা সিকিউরিটিজকে ব্যবহার করে শেয়ারবাজার থেকে দুইশ’ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ রয়েছে দুদকের হাতে। সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের গোপালগঞ্জ শাখার জন্য নাফিজ সরাফাতের মা সাজেদা সরাফাতের কাছ থেকে ৭০ টাকা বর্গফুট হিসাবে ৫ হাজার বর্গফুটের অফিস ভাড়া নেয়া হয়েছে। প্রকৃত ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি ছিল তা। নাফিজ সরাফাত চেয়ারম্যান থাকাকালে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের কারণে পদ্মা ব্যাংক দ্বিতীয়বারের মতো বিপদে পড়ে। নাফিজ সরাফাত ৫০০ কোটি টাকার একটি অংশ দিয়ে সাউথইস্ট ব্যাংকের শেয়ার কিনেছেন। কৌশলে তিনি নিজের স্ত্রী, সহযোগীসহ তিনজনকে ব্যাংকের পরিচালক পদে বসান। তিনি সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ারও চেষ্টা করছেন।
আরও পড়ুন<<>> ডলার আনে শ্রমিকরা পাচার করে ধনকুবেররা
নাফিজের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে, রাজউকের পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পে একটি প্লট বিধিভেঙে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশকে দেয়া হয়। পদ্মা ব্যাংকের আগে আইএফআইসি ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক বিপর্যয়ে জড়িত ছিলেন নাফিজ সরাফাত। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সালে ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে ৩২৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন এই নাফিজ সরাফাত। ভুয়া ঋণ আদায়ের জন্য মামলা করে ৫ কোটি টাকা আইনজীবীর ফি হিসেবে আত্মসাৎ করা হয়। নিয়মবহির্ভূতভাবে নিজ ও পরিবারের নামে অফিস ভাড়া ও অগ্রিম হিসাবে ২৫ কোটি টাকা নিয়েছেন ব্যাংক থেকে। এ ছাড়া রুগ্ণ পদ্মা ব্যাংকে নাফিজ সরাফাত সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসান খসরুর সঙ্গে যোগসাজশে ২০০ কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন। এসব নিয়োগে জনপ্রতি ৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেয়া হয়।
আরও পড়ুন<<>> দৈনিক দেড়টাকা বেতনের ব্যাটারি লোকমান এখন হাজার কোটি টাকার মালিক
ফারমার্স ব্যাংকের গাজীপুরের মাওনা শাখার ম্যানেজার শেখ কামরুল হোসেন নাফিজ সরাফাতের ভগ্নিপতি। তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কামরুল ওই শাখা থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ব্যাংকের নিয়মভঙ্গ করে শাহি ট্রেডার্সের মালিক বাদশা মিয়ার নামে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার ভুয়া ঋণ পাস করিয়ে সেই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইসিবির শেয়ারহোল্ডারশিপ বিক্রি বাবদ দুটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংকের নামে ১৫ কোটি টাকা প্রদান করা হয়। ওই পে-অর্ডার প্রিমিয়ার ব্যাংকের বনানী শাখায় নগদায়ন করে ১৫ কোটি টাকা কর্মকর্তারা বাটোয়ারা করেছেন। শেখ কামরুল ও তার স্ত্রী আনিসা চৌধুরীর যৌথ অ্যাকাউন্টে গ্রাহকের ঋণ হিসাব থেকে তার অজ্ঞাতসারে টাকা আত্মসাতের তথ্যও রয়েছে দুদকের হাতে। মাওনা শাখা থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ২০১ কোটি টাকা অনিয়মিত ঋণ বিতরণ হয়েছে। করোনাকালে শেখ কামরুল নিরাপদে কানাডায় চলে যান। নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলোর মধ্যে রয়েছে– তার ভগ্নিপতি কামরুল জাল সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি নেয়ার পর পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা না থাকলেও তাকে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছেন।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।