
ফাইল ছবি-আপন দেশ
জামালপুর পৌরসভায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকার ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। লক্ষ্য ছিল পৌরবাসীর ঘরে ঘরে নিরাপদ পানির প্রবাহ নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ৫ বছর পরও এক ফোঁটা পানি পৌঁছায়নি পৌরবাসীর কাছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, খেলার মাঠ, মসজিদ, স্কুলসহ ঈদগাহ বিলুপ্ত করে নির্মিত এ প্রকল্পে চরম দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে কেবল একটি ওভারহেড পানির ট্যাংক, যা আজও অচল। এর সঙ্গে নেই কোনো পানির সংযোগ ব্যবস্থা। ফলে এটি ‘দৃশ্যমান কাঠামো’, বাস্তব সুবিধা শূন্য। ট্যাংকই এখন মরণফাঁদ। পৌরবাসীর বুকে শতটনের একটি ট্যাংকি চাপিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছে গোপালগঞ্জের মনির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কোং নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্টরা। তাতে সহযোগিতা করেছেন জামালপুর জনস্বাস্থ্যের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ ওরফে সুলতান খাঁ।
সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাটকারী দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলীসহ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। কারণ সরকারের এমপি-দলীয় নেতারাই ছিলেন লোপাটে। এ প্রকল্প নির্মাণের জন্যে ওই এলাকায় স্কুল-ঈদগাহ মাঠ বিলুপ্ত করা হয়েছে। নিম্নমানের কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছিলেন স্থানীয় এবং তদারককারী প্রকৌশলী।
সাধারণ মানুষের প্রশ্ন- করের টাকায় তাদের বদলে ভাগ্যোন্নয়ন ঘটছে লুটপাটকারীদের। দুর্নীতি ধরতে জেলা দুর্নীতি দমন কমিশন বা সংস্থাগুলোর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ।
আরও পড়ুন<<>> জামালপুর জনস্বাস্থ্যে দুর্নীতির কিংপিন সুলতান, আমিনুল, হোয়াইট বাবু
জামালপুরে প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে দেখা দেয় বিশুদ্ধ পানির সংকট। গভীর নলকূপে পর্যাপ্ত পানি না ওঠায় সে চাহিদা মেটাতে জনস্বাস্থ্যের স্থায়ী পরিকল্পনায় পৌরসভার বগাবাইদে নির্মাণ করা হয় পানি শোধনাগার ও ট্যাংক।
পৌরসভা বলছে, পানি সরবরাহ সংযোগ কম থাকায় চালু হচ্ছে না প্রকল্পগুলো। আর বিগত মেয়রদের দোষারোপ করছেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ। তাহলে দ্বায় কার প্রশ্ন পৌরসভা বাসিন্দাদের।
জনস্বাস্থ্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পৌরবাসীর সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে ২০১৮ সালে জামালপুর পৌরসভার বগাবাইদ বোর্ডঘর মোড়ে সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয় পানি শোধনাগার। প্রকল্প এলাকায় আজাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে খেলার মাঠে শিশু শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা, পুকুর ঘাটে স্থানীয় বাসিন্দাদের গোসল, মসজিদের নানা ধর্মীয় ও সামাজিক কাজ এবং বাজারের একাংশ প্রাণবন্ত থাকতো লোক সমাগমে। প্রকল্পের স্থান নির্বাচনের সময় স্থানীয় লোকজন প্রতিবাদ করেছিল। আমলে নেয়নি তৎকালীন মেয়র শাহ ওয়ারেছ আলী মামুন।
শুরুতে ঠিকাদার ছিলেন অন্যজন। তিনি বরাদ্দ নিয়েছিলেন সাড়ে ৫কোটি টাকা। ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর জেলায় নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন বঙ্গবন্ধু পরিষদ নেতা প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ। একই স্থানেই তিনি ৩ কোটি চার লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২১ সালের পানির ট্যাংক নির্মাণ করেন। এ কাজটি নিয়েছে গোপালগঞ্জের মনির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কোং। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, পৌর মেয়র ছানোয়ার হোসেন ছানু ও নির্বাহী প্রকৌশলী পরিদর্শন করেছেন ঘটা করে। দুই প্রকল্পই ২০২১ সালে পৌরসভার কাছে হস্তান্তরের পর কার্যত একবারের জন্যও চালু হয়নি। পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে দামি যন্ত্রাংশগুলো।
আরও পড়ুন<<>> জামালপুর জনস্বাস্থ্যের কোটিপতি অফিস সহকারী হোয়াইট বাবু ছায়া নির্বাহী!
স্থানীয় বাসিন্দা আমজাদ হোসেন সুজন বলেন, আমসর বাসা এ প্রকল্পের পাশেই। উদ্বোধন করা হলেও ৫ বছরে একবারের জন্যও চালু হয়নি। শুনেছি ৮ কোটি টাকা ব্যায়ে দুটি প্রকল্পের কাজ হয়েছে। সরকার ৮ কেটি টাকা ব্যায় করলো আমাদের পানির সুবিধার জন্য। আমরা এক গ্লাস পানিও পান করতে পারলাম না।
একই এলাকার বাসিন্দা রোখসানা বেগম বলেন, আমাদের বাড়িতে পানির লাইন করে দিয়ে গেছে। কিন্তু একবারের জন্যও পানি আসেনি। সরকারের টাকা খরচ করে এটা করে লাভ কি হয়েছে। আমরা তো পানির সুবিধা পাচ্ছিনা।
পৌরসভার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সড়কের পাশ দিয়ে পানি সাপ্লাইয়ের পাইপ বসিয়েছে অগভীর ও খুবই নিন্মমানের পাইপ। এ পাইপে পানি সাপ্লাইয়ে কাজ হবেনা সমস্যা হতে পারে আমরা আগেই বুঝেছিলাম।
জামালপুর পৌরসভার পানি সরবরাহ বিভাগের পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম শফিক আপন দেশকে বলেন, এ দুটি প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও নিন্মমানের কাজ হয়েছে। যে পানির ট্যাংকে পানির উঠবে সে পাইপেরও গভীরতাও প্রয়োজনের তুলনায় কম, তাই পানির চাপ পাওয়া যাচ্ছেনা। পৌরসভার পক্ষে একবার আমরা গিয়ে কাজ বন্ধ করেছিলাম। ঠিকাদাররা প্রভাবশালী হওয়ায় পরে ফের একই কায়দায় কাজ চলেছে।
আরও পড়ুন<<>> জামালপুর জনস্বাস্থ্যে টেন্ডার নয়, ছিল ‘টিপস অ্যান্ড টাচ’
তিনি আরও বলেন, পানি সরবরাহ হবে সে পাইপ বসানোর গভীরতা নেই বললেই চলে। পাইপও নিন্মমানের। এসব নানা কারণেই চালু হচ্ছেনা।
একাধিক সূত্র জানায়, পাইপ বসানোর ঠিকাদারী কাজ পেয়েছিলো জামালপুর-৫ (সদর) আসনের আওয়ামী লীগের এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোজাফফর হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল আমীন চাঁন ও ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক মাকসুদ বিন জালাল প্লাবনসহ আওয়ামী লীগের নেতারা। প্রকল্প এলাকা ও শহরে পাইপ বসানোর তদারকীতে দায়িত্বে নিয়োজিত জনস্বাস্থ্যের প্রকৌশলীকে কাজ চলাকালীন একদিনও চোখে পরেনি।
এ কাজে দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তৎকালীন জনস্বস্থ্যের সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল মাজেদ। তিনি বলেন, আমি যতটুকু সম্ভব দায়িত্বপালনের চেষ্টা করেছি। কাঁচারীপাড়া-চামড়াগুদাম রোডে ঠিকাদার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল আমিন চাঁন নিন্মমানের পাইপ বসিয়ে কাজ করানোর সময় বাঁধা দিয়ে প্রতিবাদ করে স্থানীয় কাউন্সিলর মরহুম শাহরিয়ার আলম ইদুর নেতৃত্বে স্থানীয় জনগণ। আমি সাইডে গিয়ে এক ট্রাক নিন্মমানের পাইপ ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করি। আরেক সাইডের কাজে মানের কথা বলায় সদরের সাবেক এমপি মেজাফফরের পার্টনার তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক মাকসুদ বিন জালাল প্লাবন আমাকে প্রাণনাশের হুমকী দেয়। এমন পরিস্থিতিতে কাজের মান যাচাইয়ের সুযোগ পায়নি।
তিনি আরও বললেন, পৌরসভার কাছে আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি। মেয়রের সঙ্গে প্রকৌশলীর উপস্থিত ছিলেন। তারা পানির চাপসহ অন্যন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করেই বুঝে নিয়েছিল।
অন্যন্য অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পাশ কাটিয়ে যান প্রকৌশলী মাজেদ।
জামালপুর পৌরসভা সহকারী প্রকৌশলী (পানি) মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, পানি সাপ্লাইয়ের সংযোগ কম থাকাসহ নানা সমস্যার কারণে চালু করা যাচ্ছে না মেশিনগুলো। তাই জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
জনস্বাস্থ্যের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী সোহেল রানার সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোন খুদে বার্তা পাঠিয়ে এ বিষয়ে মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন<<>> প্রকৌশলী সুলতানের জালিয়াতি-লোপাটের ভয়ঙ্কর চিত্র,
তবে জামালপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সুলতান মাহমুদ বলেছিলেন, জামালপুরে বিভিন্ন সময় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বেশি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। তার মধ্যে এ পানি শোধনাগার ও পানির ট্যাংক। এ দুটি হস্তান্তরের পরও বন্ধ হয়ে পড়ে থাকার জন্য বিগত মেয়ররাই দায়ী। তাদের কয়েকবার বলার পরও এটি চালু করেননি।
প্রকল্প চলাকালীন জামালপুর পৌরসভার মেয়ার মির্জা সাখাওয়াতুল আলম মনি ও ছানোয়ার হেসেন ছানু আত্মগোপনে থাকায় তাদের মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে জামালপুর পৌর প্রশাসক মৌসুমি খানম বলেন, আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি, বিষয়টি জানা নেই। আমরা এখন শুধু জনবান্ধবমূলক কাজগুলো বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রকল্প দুটির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রতি ঘণ্টায় ৩৫০ ঘন মিটার ক্ষমতা সম্পন্ন পানি শোধনাগার এবং ৬৮০ কিউবেক মিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন পানির ট্যাংক চালু হলে প্রতিদিন দুই লাখ ২০ হাজার লিটার পানির চাহিদা মিটবে পৌরবাসীর।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।