Apan Desh | আপন দেশ

পরিবেশবান্ধব কারখানায় বিশ্বসেরা বাংলাদেশ!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৭:১৬, ৪ জুন ২০২৪

পরিবেশবান্ধব কারখানায় বিশ্বসেরা বাংলাদেশ!

ছবি: সংগৃহীত

২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড ও ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধস। সেই সময়টা ছিল বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের জন্য ভয়াবহ এক সময়। আন্তর্জাতিক মহল তখন বাংলাদেশের পোশাক খাত, পোশাক শ্রমিকদের জীবন অনিরাপদ বলে আঙুল তোলে। দেশের রফতানি খাতে আসে ধাক্কা। বাংলাদেশি পণ্য বয়কট করতে থাকে ক্রেতারা, কমতে থাকে অর্ডারের সংখ্যাও।

তবে সেই ধাক্কা সামাল দিয়ে এক দশকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের পোশাক খাত। বিশ্বে হয়েছে রোল মডেল। পরিবেশবান্ধব কারখানা বা গ্রিন ফ্যাক্টরির তালিকায় বাংলাদেশের ধারে কাছেও নেই অন্য কোনো দেশ। বিশ্বের প্রথম ১০০টি গ্রিন ফ্যাক্টরির মধ্যে ৫৬টিই বাংলাদেশের।

গ্রিন ফ্যাক্টরি কী?

একটি ফ্যাক্টরিতে সকাল সকাল দলবেঁধে সেখানে প্রবেশ করেন কর্মীরা। যাদের কাছে তাদের কর্মস্থল আতঙ্ক নয়, স্বস্তির জায়গা। যেখানে বসে প্রকৃতির সতেজ বাতাস নেয়া যায়। ভারী ভারী যন্ত্রপাতির ভিড়েও যেখানে প্রকৃতির গায়ে কোনো আঁচ লাগে না। গ্রিন ফ্যাক্টরির চিত্র এমনই। গ্রিন ফ্যাক্টরি বা সবুজ কারখানা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব কারখানা। যে কারখানায় উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়ে, তবে পরিবেশের ক্ষতি করে নয়।
 
গ্রিন ফ্যাক্টরির প্রকারভেদ

মোট চার ক্যাটাগরিতে ভাগ করে গ্রিন ফ্যাক্টরির সনদ দেয়া হয়। পরিবেশবান্ধব স্থাপনার শর্তগুলো কতটা মানা হয়েছে তা পরীক্ষা করে ইউএসজিবিসি সনদ প্রদান করে। মোট ১১০ পয়েন্টের মধ্যে যাচাই করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ক্যাটাগরি হচ্ছে ‘প্লাটিনাম’। যার জন্য ১১০ এর মধ্যে পেতে হয় ৮০’র বেশি পয়েন্ট।

বিশ্বের এক নম্বর পরিবেশবান্ধব কারখানা বাংলাদেশের গ্রিন টেক্সটাইল

এরপরের ক্যাটাগরি ‘গোল্ড’। যে ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত হলে থাকতে হয় ৬০-৬৯ পয়েন্ট। এরপর আসে ‘সিলভার’ ক্যাটাগরি; তার জন্য থাকতে হয় ৫০-৫৯ পয়েন্ট। আর সবশেষ ক্যাটাগরি ‘সার্টিফাইড’। এর জন্য থাকতে হয় ৪০-৪৯ পয়েন্ট।
 
কীভাবে নির্ধারিত হয়?

এ পয়েন্টগুলো নির্ধারণের জন্য আবার শর্ত থাকে। লিড কারখানার স্বীকৃতি পেতে হলে বেশ অনেকগুলো শর্ত পালন করতে হয়। সবার আগে প্রাধান্য দেয়া হয় কারখানা তৈরিতে যে নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার হয়েছে তাতে যেন কার্বন নিঃসরণ কম হয়। এছাড়া ইট, সিমেন্ট ও অন্যান্য সামগ্রী পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে কিনা।
 
সব উপকরণ কারখানার সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা হয়েছে কিনা। কারণ, এতে পরিবহনের জন্য জ্বালানি কম খরচ হয়। যেখানে কারখানা হবে তার নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে শ্রমিকদের বাসস্থান, স্কুল, বাজার, বাস বা টেম্পো স্ট্যান্ড থাকতে হবে। কারণ দূরে হলেই শ্রমিকদের কারখানায় আসতে গাড়ির প্রয়োজন হবে। এতে জ্বালানি খরচের পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ হবে।
 
১১০ পয়েন্টকে আবার সাতটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে এ সার্টিফিকেশন দেয়া হয়। সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয় প্রাকৃতিক শক্তির ব্যবহারকে। এজন্য বরাদ্দ থাকে ৩৫ পয়েন্ট। এরপর সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট জমির ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর। এজন্য বরাদ্দ আছে ২৬ পয়েন্ট। অভ্যন্তরীণ পরিবেশের জন্য থাকে ১৫ পয়েন্ট, পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের জন্য থাকে ১৪ পয়েন্ট। পানি সাশ্রয়ের জন্য থাকে ১০ পয়েন্ট। অতি সাম্প্রতিক উদ্ভাবিত যন্ত্রের ব্যবহারের জন্য ৬ পয়েন্ট এবং এলাকাভিত্তিক প্রাধান্যের জন্য ৪ পয়েন্ট।
 
এছাড়াও বেশ কিছু শর্ত থাকে। যেমন, কারখানায় সূর্যের আলোর কী পরিমাণ ব্যবহার হয়, বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার করা হয় কিনা, সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাতি ব্যবহার করা হয় কিনা, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা ব্যবহার করা হয় কিনা, কারখানা নির্মাণে নির্দিষ্ট পরিমাণ খোলা জায়গা রাখা হয়েছে কিনা, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আছে কিনা, বৈদ্যুতিক ফিটিংস স্থাপন ছাড়াও অগ্নি দুর্ঘটনা এড়াতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে কিনা।
 
এমন আরও সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়কে যাচাই করা হয় লিড সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য। মোট কথা, একটি পোশাক কারখানা তার নিয়মে কাজ করবে তবে সেখানে কর্মীদের শতভাগ নিরাপত্তা থাকতে, পরিবেশের নিরাপত্তা থাকতে হবে। আর এর ওপর নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা সেই কারখানার পোশাক কিনবে কি কিনবে না।
 
বাংলাদেশের সফলতা 

এবার আসি বাংলাদেশের সফলতার গল্পে। তবে সফলতায় আসার আগে সেই কালো অধ্যায়কে স্মরণ করতে হবে। ২০১২-১৩ সেই সময়টা বাংলাদেশের পোশাক খাতের ইতিহাসের জন্য সবচেয়ে খারাপ সময় বলা যায়। তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড ও রানাপ্লাজা ধসে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাক খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। বাংলাদেশি পণ্য বয়কটের ডাক ওঠে।
 
এরপরই মূলত ঘটে সবুজ বিপ্লব। যা বাংলাদেশের পোশাক খাতকে বিশ্ব-দরবারে নতুন করে হাজির করে। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের পোশাক আবার ফিরে পেতে থাকে গ্রহণযোগ্যতা। শুধু তাই নয়, এরপর আর বাংলাদেশের ধারে কাছে আসতে পারেনি বিশ্বের অন্য কোনো দেশ।
 
বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ২১৮টি লিড কারখানা আছে। যার মধ্যে প্লাটিনাম ৮৪টি, গোল্ড ১২০টি, সিলভার ১০টি, সার্টিফাইড ৪টি। বিশ্বসেরা ১০০টি কারখানার মধ্যে ৫৬টিই বাংলাদেশের।

গ্রাফিক্স চিত্রে বাংলাদেশের পোশাক খাতে পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা

বাংলাদেশের পরে আছে পাকিস্তান; তবে সে সংখ্যা মাত্র ৯টি। আবার প্রথম ১০টির মধ্যে ৮টি বাংলাদেশের কারখানা। বাংলাদেশের সফলতা চোখে পড়ার মতো।
 
গ্রিন ফ্যাক্টরি হয়ে লাভ কী?

 
অতিরিক্ত খরচ করে, কারখানাকে পরিবেশ বান্ধব করে পরিবেশের অনেক লাভ হচ্ছে তা ঠিক, তবে ব্যবসায়ীদের কী লাভ? পরিবেশবান্ধব কারখানা তৈরিতে অতিরিক্ত খরচ যদি হয়ও সেই খরচটাকে ব্যবসায়ীরা দেখতে পারে বিনিয়োগ হিসেবে। কারণ বর্তমানে পরিবেশবান্ধব কারখানায় পণ্য তৈরি হওয়া মানে বিশ্ববাজারে একধাপ এগিয়ে থাকা।
 
পোশাক খাতের ক্রেতারা অর্ডার করে এ গ্রিন ফ্যাক্টরি দেখে। তিনি যেই পণ্যটি কিনছেন সে পণ্য তৈরিতে পরিবেশের বা কর্মীর কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা এটা আন্তর্জাতিক মহলে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। এগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক বড় বিষয়। তাই পরিবেশবান্ধব কারখানাগুলোর আন্তর্জাতিক বাজারে গ্রহণযোগ্যতাও বেশি থাকে। স্বাভাবিকভাবে লাভের হিসেবের পাল্লা তাদেরই ভারী থাকবে।

আপন দেশ/এসএমএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়