ছবি: বিবিসি
একজন ব্যক্তির আয়ের ওপর নির্ভর করে তাকে প্রতিবছর আয়কর দিতে হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর বাজেটে দেখা যায় কর কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন থাকে। আর সেদিকে অনেকের নজর থাকে। সরকার যখন রাজস্ব আহরণে মরিয়া তখন আয়কর থেকে রাজস্ব বাড়ানো তাদের অন্যতম টার্গেট থাকে।
গত কয়েকবছর ধরে অনেকেই বলছেন যে চাকরিজীবীদের ওপর ‘করের বোঝা’ বেড়েই চলেছে। এক্ষেত্রে আবার সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে তফাত রয়েছে। বেসরকারি চাকরিজীবীরা কর কাঠামোতে নানাভাবে বৈষম্যের মুখে পড়ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সঞ্চয়পত্র
নতুন আয়কর আইনে সঞ্চয়পত্রের মুনাফাকে করদাতার আয় হিসেবে ধরা হয়েছে। কিন্তু এর আগে এ খাতের মুনাফার টাকা করদাতার আয় হিসেবে যুক্ত করা হতো না। শুধুমাত্র মুনাফার উপর ১০ শতাংশ উৎসে কর কেটে রাখা হতো। ফলে এটিও বাড়তি কর হিসেবে যুক্ত হচ্ছে।
চাকরিজীবীরা কিংবা স্বল্প আয়ের হাজার হাজার মানুষ তাদের জমানো টাকা থেকে সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেন। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবত সঞ্চয়পত্রের মুনাফা নানাভাবে কমানো হয়েছে।
সরকার বলছে, সঞ্চয়পত্রকে তারা নিরুৎসাহিত করতে চায়। যদিও ১৫ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি
চাকরিজীবীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্র্যাচুইটি গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়। অবসরে যাবার পর এ দুটো খাতে থেকে যে টাকা পাওয়া যায়, সেটির ওপর তারা বাকি জীবন নির্ভর করেন।
গত বছর থেকে বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটিসহ বেশ কয়েকটি খাতে করের বোঝা চাপানো হয়েছে।
বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড বা কল্যাণ তহবিলের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। যদিও সরকারি চাকরিজীবীদের এ খাতের অর্জিত আয়কে কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
এছাড়া গ্রাচুইটি তহবিল এবং লভ্যাংশ তহবিলের যে কর ছাড়ের সুযোগ ছিল সেটিও তুলে নেয়া হয়েছে।
আয়কর আইনজীবী দিহিদার মাসুম কবির বলেন, ‘একইসঙ্গে অনুমোদিত প্রভিডেন্ট ফান্ডে ইন্টারেস্টের ওপর কর দিতে হতো না। কিন্তু এখন ১৫ শতাংশ হারে ওই ফান্ড থেকে ট্যাক্স দিতে হবে। অর্থাৎ করদাতার কাছ থেকেই ট্যাক্স দিতে হবে। একদিকে করমুক্ত সীমা বাড়ালেও কিন্তু বেসরকারি চাকরিজীবীদের এসব কারণে খুব একটা সুবিধা হবে না।’
বেসরকারি চাকরিজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘সরকার করমুক্ত সীমা ৫০ হাজার বাড়িয়েছে ঠিকই কিন্তু ইনভেস্টমেন্টের ট্যাক্স রেয়াতের হার কমিয়েছে। আবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের আয়ের ওপর ট্যাক্স দিতে হবে। এ মুহূর্তে পি এফ থেকে কাটবে না কিন্তু ভবিষ্যতে যে ইনকাম পেতাম তার থেকে কম পাব। ফলে সীমা বাড়িয়েও আমাদের কোনো লাভ হয়নি।’
একদিকে কমবে অন্যদিকে বাড়বে
আয়কর আইনজীবীরা বলছেন, নতুন কর আইনে করমুক্ত সীমা বাড়ার ফলে আপাত দৃষ্টিতে কর কমছে বলে মনে হলেও মূলত বেসরকারি চাকরিজীবীদের ওপর করের বোঝা আরও বাড়বে।
এছাড়া বিভিন্ন পণ্যে ভ্যাট বসানোর ফলে নতুন আয়কর আইনানুযায়ী করমুক্ত সীমা বাড়লেও তাতে খুব একটা লাভবান হচ্ছেন না বেসরকারি চাকরিজীবীরা। কারণ টাকার মান কমা, মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা নিয়ামক এতে প্রভাব ফেলছে।
আইনজীবীরা বলছেন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটি খাতের অর্জিত আয়ে কর, বিনিয়োগের জন্য যে রেয়াত দেওয়া হয় সেটি কমানো ছাড়াও বিভিন্নভাবে সরকার ভ্যাট আদায় করছে। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ করের বাইরেও পরোক্ষ করের কারণে করমুক্ত সীমা বৃদ্ধি পেলেও সাধারণ মানুষ ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য করের বোঝা বাড়ছেই।
রেয়াত কমানো
কর রেয়াত বলতে কর কমানো বা কর কম দেয়াকে বোঝায়। বিনিয়োগ বা দান হলো কর রেয়াতের বৈধ উপায়। প্রতি বছর জুলাই থেকে পরের বছরের জুন পর্যন্ত এ ১২ মাসের আয়ের ওপর কর বসে। এ সময়ের মধ্যে বিনিয়োগ করলে কর রেয়াত পাওয়া যায়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অনুমোদিত নির্ধারিত কয়েকটি খাতে বিনিয়োগ এবং দানে উৎসাহিত করার জন্য সরকার ওই সমস্ত বিনিয়োগ এবং দানের ওপর এ ছাড় দিয়ে থাকে। যার মাধ্যমে করের পরিমাণ বহুলাংশে কমানো যায়।
যদিও গত বছর করমুক্ত আয়ের সীমা খানিকটা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কর রেয়াতের ক্ষেত্রে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে গত বছরের কর আইনে, তাতে সাধারণ করদাতাতের জন্য করের বোঝা আরও বেড়েছে।
আয়কর আইনজীবী কামরুল হোসেন বলেন, ‘স্ল্যাব বাড়ানোর ফলে করদাতা প্রাথমিকভাবে ধরতে পারবে না। সে মনে করবে করের বোঝা কমেছে। কিন্তু করদাতার বিনিয়োগের ওপর যে রেয়াত নিবে সেখানে পারসেন্টেজ কমিয়ে দেয়া হয়েছে।’
হোসেন বলেন, ‘উদাহরণস্বরূপ আমার এক লাখ টাকা বিনিয়োগে আগে রেয়াত পাওয়া যেতো ৬০ হাজার টাকা। ৪০ হাজার টাকা ট্যাক্স দিতে হতো। এখন রেয়াতের পারসেন্টেজ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই এক লাখ টাকায় ট্যাক্স দিতে হবে ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ বিভিন্ন বিনিয়োগের ফলে যে রেয়াত দেয়া হয় এখন তার হার কমানো হয়েছে। এখানে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে।’
আরও করের বোঝা
বাংলাদেশে ২০২৩ সালে নতুন আয়কর আইন প্রণয়ন করা হয়। এতে করমুক্ত সীমা বাড়ানো হয়েছে। পুরুষদের করমুক্ত সীমা নির্ধারণ হয় সাড়ে তিন লাখ টাকা। যা আগে ছিল তিন লাখ টাকা। নারীদের জন্য এ সীমা করা হয়েছে চার লাখ টাকা। যা আগে ছিল সাড়ে তিন লাখ টাকা।
এর আগে, ২০২২ সালে লিভ ফেয়ার এসিসটেন্স (এলএফএ) নামে চাকরিজীবীদের এক ধরনের ভাতা দুই বছরে একবার করমুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু গত বছর যে নতুন আইন করা হয়, তাতে এ খাতের করমুক্ত সুযোগ একেবারেই বাতিল করা হয়েছে। ফলে এটিও ব্যক্তির করের তালিকায় অতিরিক্ত বোঝা হিসেবে যুক্ত হয়েছে। (এলএফএ) এটি চাকরিজীবীদের ভ্যাকেশন বোনাস বা উৎসব ভাতা হিসেবে পরিচিত।
আয়কর আইনজীবী দিহিদার মাসুম কবির বলেন, ‘বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান এলএফএ দেয়। আগে এতে নির্দিষ্ট মেয়াদের পর কর ছাড়ের সুযোগ ছিল। এটা এখন বাতিল করা হয়েছে।’
আবার, জমি বিক্রি করার মুনাফা এ কর-বর্ষ থেকে করদাতার আয় হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এখন থেকে এ খাতে মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ গেইন ট্যাক্স দিতে হবে। অথচ এর আগে এ খাতে শুধুমাত্র উৎসে কর কাটা হতো।
মূল্যস্ফীতির চাপ
আয়কর হচ্ছে সরকারি রাজস্ব বা আয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এ আয় বাড়াতে এনবিআর প্রতিবছর বাজেটে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের ওপর শুল্ক, কর ও ভ্যাট বাড়িয়ে বা কমিয়ে থাকে। এর ওপর ভিত্তি করে বাজারে ঐসব পণ্যের দাম বাড়ে অথবা কমে। এর প্রভাব পড়ে জনগণের ওপর।
প্রতি বছরই বাজেট ঘোষণার পর বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ে। অনেক পণ্যের ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়। আবার কিছু কিছু পণ্যে নতুন করে ভ্যাটও যুক্ত করা হয়। ফলে বিভিন্ন ধরনের পরোক্ষ করের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ডলারের মূল্য বাড়ছে একদিকে, অন্যদিকে টাকা ডিভ্যালুয়েশন হচ্ছে। ফলে আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে ভোক্তাকেই পণ্যের মূল্য বাবদ বাড়তি অর্থ দিতে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ছে। সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে, ক্রয় ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে।’
গত বছর আয়ের করমুক্ত সীমা বাড়ানো হলেও বিভিন্ন পণ্য বা সেবায় ভ্যাট কেটে নেয়া, নানা ধরনের সুবিধা কমানো এবং মূল্যস্ফীতিসহ নানা কারণে জনগণের জন্য বিশেষত বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য তা কোনো সুফল বয়ে আনেনি।
বাংলাদেশের একটি গণমাধ্যমের সাংবাদিক রাকিবুল হাসান বলেন, ‘২০২২ সালে আনুমানিক ৫৫ হাজার টাকা আয়কর দিয়েছি। আয় বাড়ার কারণে পরের অর্থবছরে আরও ছয় হাজার টাকা বেশি দিতে হয়েছে।’
তবে, প্রত্যক্ষ করের চাইতে পরোক্ষ করই বেশি দেয়া হয় বলে জানান তিনি। কারণ সরকার বিভিন্নভাবে নানা ধরনের ভ্যাট কেটে নিচ্ছে।
হাসান বলেন, ‘তবে একটিভ ট্যাক্সের চাইতে প্যাসিভ ট্যাক্স বেশি দেই। যেটা ভ্যাট হিসেবে কাটা হয়। রাষ্ট্র এটা নিশ্চিত করতে পারেনি ভ্যাট নিলে সেলারের কাছ থেকে নেয়ার কথা। কিন্তু গ্রাহকের কাছ থেকেই ভ্যাট নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এগুলো হিসাব করলে বছরে বহুত বেশি দিচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটা রেস্টুরেন্টে খেলে ১৫ পারসেন্ট ভ্যাট দিচ্ছি, সুপারসপে গেলেও ভ্যাট দিতে হচ্ছে। ফলে এসব হিসেবেই অনেক বেশি প্যাসিভ ট্যাক্স দিচ্ছি।’
সূত্র: বিবিসি
আপন দেশ/এসএমএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।