
মাসুদ রানা (উপরে), মুহাম্মদ মহসীন হোসাইনী ও কামাল হোসেন (নীচে)। ছবি: সংগৃহীত
বিগত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোতে গড়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট সদস্যরা প্রভাবশালী এস আলম গ্রুপসহ দেশের অসাধু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর তাঁবেদারি করত। নির্বিঘ্নে ব্যাংক থেকে অর্থ লুট ও পাচারের সব ধরনের ব্যবস্থা করাই ছিল তাদের দায়িত্ব। বিনিময়ে পেতেন অর্থনৈতিক সুবিধা, বিদেশ ভ্রমণের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ দফতরে পদায়ন।
এমন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বিএফআইইউতে। দেশের অর্থ পাচার রোধ করার দায়িত্ব এ সংস্থাটির। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা এ সংস্থায় কাজ করেন।
বিএফআইইউ’র সিন্ডিকেটটি গড়ে উঠেছিল মুহাম্মদ মহসীন হোসাইনী, কামাল হোসেন ও মাসুদ রানার নেতৃত্বে। মহসীন, কামাল হোসেন ও মাসুদ রানা অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন বিএফআইইউতে। এ সিন্ডিকেটের দাপটে তটস্থ ছিলেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। এমনকি, বিএফআইইউর তৎকালীন উপপ্রধান জহুরুল হুদাও এ সিন্ডিকেটকে নিজের কাছে টানেন। লক্ষ্য ছিল এদের সহায়তা নিয়ে আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হওয়া। জহুরুল হুদার একাধিক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
জুলাই বিপ্লবে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়ন্ত্রণ খর্ব হয় বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠীগুলোর। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্বে এসে ভেঙে দেন বিএফআইইউর সিন্ডিকেট। কামাল হোসেনকে পাঠানো হয় বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রকল্পে। মহসীন হোসাইনীকে পাঠানো হয় ফাইন্যানশল ইন্টিগ্রিটি এন্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্টে (এফআইসিএসডি)। মাসুদ রানাকে পাঠানো হয় বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতে (বিবিটিএ)। জহুরুল হুদা নির্বাহী পরিচালক পদে থেকে স্বাভাবিক অবসরে গেছেন। সম্প্রতি বিএফআইইউ প্রধান নিয়োগ পেতে বেশ দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা গেছে তাকে। তবে এস আলম সংশ্লিস্টতার কারণে খুব বেশি এগোতে পারেননি মি. হুদা।
আরও পড়ুুুুুুুুুুন<<>> গভর্নরকে একহাত নিলেন এবি ব্যাংকের চলতি এমডি সৈয়দ মিজান
তবে ফের এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ নিতে চাচ্ছে এ সংস্থাটির। কারণ, আর্থিক খাতে গ্রুপটির নিয়ন্ত্রণ ফেরাতে এ সংস্থাটির সহযোগিতা আবশ্যিক। তাই এস আলমের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে ওই তিন কর্মকর্তা নিরবচ্ছিন্ন দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। চেষ্টা চালাচ্ছেন বিএফআইইউতে ফেরার। করছেন নানামুখী শক্ত তদবির। কৌশলে বিভ্রান্ত করছেন নীতিনির্ধারকদের।
বিএফআইইউর এ সিন্ডিকেটের বিতর্কিত কার্যক্রম বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকে 'ওপেন সিক্রেট'। তবে তারা প্রকাশ্যে আসে ২০২৩ সালের জুনে। তখন চট্টগ্রামে রাজকীয় বিয়ের অনুষ্ঠান হয় এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের ছেলে আহসানুল আলমের। ওই বিয়েতে অংশ নেন জহুরুল হুদা, কামাল হোসেন ও মহসীন হোসাইনীসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা। ওই বিয়েতে ঢাকা থেকে কয়েকজন কর্মকর্তা সাইফুল আলমের পিএস আকিজ উদ্দিনের সঙ্গে চার্টার্ড বিমানে গিয়েছিলেন।
ঘটনা এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সাইফুল আলমের জামাতা ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদের ভাইয়ের বিয়েতেও অংশ নিয়েছিলেন জহুরুল হুদা সহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।
আহসানুল আলমের বিয়েতে অংশ নিতে কামাল হোসেন ও মহসীন হোসাইনী বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিসের তৎকালীন প্রধান জহুরুল হুদা একটি প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এতে প্রশিক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানান কামাল ও মহসীনকে। তারা প্রশিক্ষণে গিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেন। জহুরুল হুদাসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বক্তব্যে বিষয়টি প্রতীয়মান হয়েছে। যদিও এটিকে দৈবঘটনা হিসেবেই দাবি কামাল হোসেন ও মহসীন হোসাইনীর।
আরও পড়ুন<<>> মতিঝিলে আ.লীগের ঝটিকা মিছিল, এবি ব্যাংক কর্মকর্তাসহ ১৫১ জনের বিরুদ্ধে মামলা
দক্ষতার দোহাই দিয়ে কামাল ও মহসীনের পাশাপাশি মাসুদ রানাও দীর্ঘদিন ধরে বিএফআইইউতে কর্মরত ছিলেন। এ সময়ে তারা ঘন ঘন বিদেশ সফর বাগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি নানাভাবে লাভবান হয়েছেন। বছরে গড়ে তিনবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন একেকজন। গড়ে তুলেছেন বেনামি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মাসুদ রানার এমন একটি বেনামি ফিনটেক কোম্পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। নাম ইজি ফিনটেক লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রকাশ্যে ক্যাম্পেইনও চালিয়েছেন তিনি।
বিভিন্ন শিল্প গোষ্ঠীকে কয়েক লাখ কোটি টাকা অর্থ পাচারে সহায়তা করে বিএফআইইউ’র সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস এখন কারাগারে। তার অবৈধ সম্পদেরও খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু মাসুদ বিশ্বাস বিচারের মুখোমুখি হলেও দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে বিএফআইইউতে ফিরতে চাচ্ছেন কামাল, হোসাইনী ও মাসুদ রানারা। কারণ, কামাল হোসেন ও মহসীন হোসাইনী ৫ আগস্টের পর পদোন্নতি পেয়ে পরিচালক হয়েছেন। তাদের সঙ্গে আছে দুই সিনিয়র সচিবের আশীর্বাদ, যারা শেখ হাসিনার আমলে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
এ নিয়ে ক্ষোভ ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মাঝে। এ সিন্ডিকেট বিএফআইইউতে ফিরলে একদিকে আর্থিক খাতে সুশাসন ফেরাতে সরকারের উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে সাধারণ কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ হারাবেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হলে আরও অনেক কর্মকর্তা অনিয়মে আকৃষ্ট হবেন স্বাভাবিকভাবেই। এমন মত বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ও আর্থিক খাতের বোদ্ধাদের।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।