
ওমর ফারুক খান। ইনসেটে নজরুল ইসলাম মজুমদার।
আর্থিকখাতে দুর্নীতির জন্যই অতলে ডুবিয়েছিল দেশ। গণঅভুত্থানে পতট ঘটেছে স্বৈরাচার সরকারের। নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে দেশ। তাতে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে আর্থিকখাতকে। ব্যাংকের দুর্নীতিপরায়ন কর্মকর্তাদের অপসারণ করা হচ্ছে। বসানো হচ্ছে স্বচ্ছ ও সৎ কর্মকর্তাদের। এমনই বদল ইসলামী ব্যাংকেও। এমডি বদল করে ডিএমডিকে এমডির (চলতি) দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে ইসলামী ব্যাংক কি কাঙ্খিত এমডি পাচ্ছে?
দেশের ব্যাংক খাতের জনপ্রিয় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। ব্যাংকটি শরীয়াহ ভিত্তিক পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও তাতে রাহুর দশা ছাড়ছে না। প্রায় দেড় যুগ ধরে অর্থ খাতের মাফিয়াদের ইচ্ছেমতো লুটপাট চলছে এ ব্যাংকে। স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে, কিন্তু ব্যাংকটির রাহুমুক্ত হচ্ছে না। উল্টো দুর্নীতি বহাল আছে, দুদকের খাতায় যাদের নাম রয়েছে এবং মাফিয়াদের ‘দালাল’ খ্যাত কর্মকর্তাদের প্রমোশন দেয়া হচ্ছে। পুনর্বাসন করা হচ্ছে, ফ্যাসিস্টদের দোসরদের। ফলে ব্যাংকটির ইতিহাসে এরাও বড় ধরনের লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছে ব্যাংকটি।
অনেক আশা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটির উদ্যোক্তাদের এখনও পড়তে হচ্ছে নানা প্যাঁচে। আগের ধারায় ফিরাতে সরকার ও উদ্যোক্তারা চেষ্টা করছে। মাফিয়া এস আলমের পৃষ্ঠপোষকতায় বসানো ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মনিরুল মওলাকে আপাতত ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। গত বোর্ড সভায় মনিরুল মওলাকে তিনমাসের জন্য বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয়েছে। এর পেছনে দুই কারণ দেখানো হয়েছে। একটি হলো- এস আলমের দাসত্ব গ্রহণ করে তিনি লাখো কোটি টাকা নামে-বেনামে ঋণের নামে লোপাটে সহায়তা করেছেন, দুর্নীতিতে যুক্ত হয়েছেন। অন্য কারণ হলো- ব্যাংকের প্রতি সাধারণ গ্রাহকদের আস্থা তলানীতে, তা ফেরাতে টপ লেভেলে একটা পরিবর্তন দৃশ্যমান করা। যাতে ক্ষুণ্ন হওয়া ইমেজ উদ্ধার হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে সায় দিয়েছেন বলে ব্যাংকসূত্রের দাবি।
আরও পড়ুন<<>> ইসলামী ব্যাংকে জালিয়াতের অভিযোগে এমডির বাধ্যতামূলক ছুটি
এদিকে মনিরুল মওলাকে ছুটিতে পাঠিয়ে এমডি (চলতি দায়িত্ব) করা হয়েছে ব্যাংকের ডিএমডি ওমর ফারুক খানকে। নতুন কোনো পরিস্থিতি তৈরী না হলে তিনিই হবেন এমডি। তবে কি পরিচ্ছন্ন এমডি পেলো ইসলামী ব্যাংক? এমন প্রশ্নের জাবাব খুঁজতেই ব্যাংকের পিয়ন থেকে উদ্যোক্তা পর্যায়ে একাধিক ব্যক্তির সোজাসাপ্টা মন্তব্য হলো, ‘চোর তাড়িয়ে ডাকাতের হাতে পড়তে যাচ্ছে ইসলামী ব্যাংক’।
সাইফুল আলম (এস আলম) ছিলেন মনিরুল মওলামের গডফাদার। তিনি তার গ্রুপসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে ইসলামী ব্যাংক থেকে লোপাট করেছেন। মনিরুল মওলার স্থানে বসানোর প্রক্রিয়া চলা ওমর ফারুকের গডফাদারের নাম নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত অর্থসংগ্রহকারী ব্যাংকিং খাতের চাঁদা সংগ্রাহক হিসেবে পরিচিত। শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই নয়, দেশের সরকারি-বেসরকারি সকল ব্যাংক থেকে লুট করে পতিত সরকার প্রধানের নানা ফান্ডে জমা দিতেন। অর্থনীতির খাতকে ডুবিয়ে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনার এ অলিগার্ক নজরুল মজুমদার-এস আলমরা।
ব্যাংক সূত্র জানা যায়, নজরুল ইসলাম মজুমদার ইসলামী ব্যাংকে ২০১৭ সালের পর থেকে ঋণের অঙ্ক বাড়িয়েছেন। এর আগে গ্রাহক থাকলেও ঋণের পরিমাণ ছিল যৎসামান্য। এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটি দখলে নেয়ার পর থেকে মজুমদার প্রভাব খাটিয়ে নিজেও ঋণ নিতে শুরু করেন। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ইসলামী ব্যাংক থেকেও দুই হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদার। বর্তমানে এসব ঋণের ২১৫ কোটি টাকা মেয়াদোত্তীর্ণ। ধীরে ধীরে ঋণগুলো খেলাপি হওয়ার পথে।
মজুমদারের ঋণ মূলত দেয়া হয়েছে ব্যাংকটির লোকাল শাখা থেকে। এ শাখায় ম্যানেজার হিসেবে ইভিপি মো. ওমর ফারুক খান যোগদান করেন। মজুমদারের নাসা গ্রুপের বেশির ভাগ ঋণ তার মেয়াদকালেই দেয়া হয়েছে। পরবর্তী ছয় বছরে ২টি পদোন্নতি নিয়ে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) হন ওমর ফারুক খান। তিনি ইসলামী ব্যাংক ছাড়েন ২০২৩ সালের ২৮ মার্চ। গত বছরের ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর আবার ইসলামী ব্যাংকে যোগদান করেন নজরুল ইসলাম মজুমদারের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠা এই কর্মকর্তা ওমর ফারুক।
ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে এক কর্মকর্তা আপন দেশ’কে বলেন, যেই মনিরুল সেই ওমর ফারুক। দু’জনেই উদ্যোক্তাদের সঙ্গে, ইসলামী ব্যাংকের আমানতকারীদের সঙ্গে মুনাফেকি করেছেন, বেঈমানি করেছেন। তারাসহ একটি বৃহৎ সিন্ডিকেটের ওপর ভর করেই এ ব্যাংটিকে অতলে ডুবিয়েছে এসআলম-নাসার মালিকরা। অদক্ষ, অযোগ্যদের মোটা অঙ্কের বেতনে চাকরি দিয়েছেন, যোগ্যদের বদলি করেছেন, চাকরিচ্যুত করেছেন। নামাজি আর মুখে দাঁড়ি থাকলেই জামায়াত-জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে পদত্যাগপত্রে সই নিয়েছেন। এতে সহায়তা নিয়েছেন ডিবি হারুনদের মতো আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের। আবার বড় কর্তাদের পদত্যাগে বাধ্য করেছেন এস আলম নিজেই।
আরও পড়ুন<<>> ইসলামী ব্যাংকের জলিলের আরও জালিয়াতির খোঁজ পেল কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মনিরুল মওলা, ওমর ফারুকরা জামায়াতেরই লোক ছিলেন। কিন্তু তারা আদর্শচ্যুত হয়েছিলেন। হয়ত পরিস্থিতির কারণে হয়ে থাকতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি মেনে মনিরুল মওলাকে সরিয়ে ওই পদে বসানো যায় এমন লোক তাদের আদর্শের নেই। তবে তিনি (ওমর ফারুক) ওয়াদাবদ্ধ যে, সামনের দিনে সততার সঙ্গে কাজ করবেন। এস আলমের দেয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধীরে ধীরে সরাবেন। বঞ্চিতদের সুযোগ দিবেন। যা ইতোমধ্যে শুরুও করেছেন তিনি। তবে বেশিদিন তাকেও এ পদে রাখা ঠিক হবে না। কারণ দুদকের অনুসন্ধানে তিনিও দুর্নীতিবাজ-এমন মতামতও ব্যক্ত করেন ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এ কর্মকর্তা।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম, এমডি মনিরুল মওলা এবং ওমর ফারুকসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আরও মামলার প্রস্তুতি চলমান।
ওমর ফারুক খানের বক্তব্য
চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত এমডি ওমর ফারুক খান বলেন, আমি ১৯৮৬ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ব্যাংকটির লোকাল অফিসে যোগদান করেছিলাম ২০১৭ সালে। নাসা গ্রুপ ১৯৯২ সাল থেকেই ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করে। তারা ভালো গ্রাহক ছিলো। আমি যখন ছিলাম তখন ২ হাজার কোটি টাকা নেয়নি।
পদোন্নতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লোকাল শাখায় আমি ইভিপি হিসেবে যোগদান করি। এরপর এসইভিপি ও ডিএমডি হয়েছি। ৬ বছরের ব্যবধানে পদোন্নতি পেয়েছি। আমি ৩৩ বছরে ডিএমডি হয়েছি। আমার আগে অনেকেই ২৭/২৮ বছরেও ডিএমডি হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক পরিস্থি বা ব্যাংক সেক্টরে কী কী হয়েছে তা তো জানেন। ২০২৩ সালের ২৮ মার্চ আমি ইসলামী ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হই।-বলেন ওমর ফারুক খান।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।