মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী
মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই রয়েছেন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের সঙ্গে। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন দায়িত্ব পালন করছেন আর্থিকখাতে সুনাম অর্জনকারী এই ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে।
আদর্শ ব্যাংকের বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করে দুই যুগের মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অর্জন, পরিকল্পনা, দেশের ব্যাংক খাতের গতিপ্রকৃতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন আপন দেশ-এর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ প্রতিবেদক মশিউর রহমান
২৪ বছর পূর্ণ করে প্রতিষ্ঠার রজত জয়ন্তীর বছরে যাচ্ছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। দীর্ঘ এ পথচলায় অর্জন সম্পর্কে জানাবেন।
১৯৯৯ সালের ২ জুন দেশের তৃতীয় প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের যাত্রা। সমসাময়িক সময়ে দেশে আরো অনেক ব্যাংকের জন্ম হয়েছে। গত দুই দশক দেশের সব ব্যাংকই তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে। এর মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংক যে অবস্থানে এসেছে সেটি অবশ্যই গৌরবের। সাফল্য ও গর্বের সঙ্গেই ব্যাংকটি ২৪ বছর পার করতে পেরেছে। সমসাময়িক অন্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অবস্থান অনেক সুদৃঢ়। বাংলাদেশের হাতে গোনা যে কয়টি ব্যাংকের আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠান মুডি’সের রেটিং আছে, মার্কেন্টাইল ব্যাংক তার একটি।
একটি ব্যাংককে আদর্শ ব্যাংক বলার জন্য যে কয়টি বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার, আমাদের ব্যাংকে তার সবক’টিই রয়েছে। মূলধনের পর্যাপ্ততা, মানসম্পন্ন সম্পদ, সুষম আয়, মজবুত তারল্য ও ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতার দিক থেকে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ়। পরিচালনা পর্ষদের বিচক্ষণ নীতি ও সিদ্ধান্ত এবং ব্যাংকের কর্মকর্তা- কর্মচারীদের ঐকান্তি প্রচেষ্টায় মার্কেন্টাইল ব্যাংক আজকের অবস্থান তৈরী করতে পেরেছে। এ অবস্থানের জন্য ব্যাংকের সম্মানিত গ্রাহকদের অবিচল আস্থা, বিশ্বাসও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
করোনা অতিমারী, ডলার সংকট, ঋণ ফেরত না আসা, আমানত উত্তোলনের হিড়িকসহ ব্যাংক খাত নানামুখী চাপের মধ্যে। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অবস্থা জানতে চাই।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব অর্থনীতিই এ মুহূর্তে চাপের মধ্যে রয়েছে। ২০২০ সাল ছিল কভিডসৃষ্ট দুর্যোগের বছর। মানবিক ও অর্থনৈতিক ওই দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল। তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো প্রবৃদ্ধির ধারায় আছে। নানামুখী চাপ সত্ত্বেও ২০২২ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংক ভালো করেছে। গত বছর আমরা ৭১৩ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা পেয়েছি। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আমানত, ঋণ,আমদানি, রফতানিসহ সবক’টি সূচকেই প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমাদের কাছে জমা আছে গ্রাহকদের ২৯ হাজার ৪০৬ কোটি টাকার আমানত। এ আমানত থেকে আমরা গ্রাহকদের ২৮ হাজার ৮৭ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছি। গত বছর মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মাধ্যমে ২৫ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকার পণ্য আমদানি ও ২০ হাজার ৯২২ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়েছে। আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে এসেছে ৬ হাজার ৮২৭ কোটি টাকার রেমিট্যান্স। আগামী দিনগুলোয় মার্কেন্টাইল ব্যাংকের প্রতিটি আর্থিক সূচক ধারাবাহিক উন্নতি করার বিষয়ে আমি অনেকটাই আশাবাদী।
সারা দেশে ব্যাংকের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করতে কী ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন?
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সেবা পৌঁছে দিতে আমরা উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে জোর দিচ্ছি। পাশাপাশি ব্যাংকের প্রযুক্তি ব্যবস্থাকে সর্বাধুনিক করে গড়ে তোলা হচ্ছে। গ্রাহক যাতে ব্যাংকে না এসে ঘরে বসে সব ধরনের সেবা উপভোগ করতে পারেন, সে উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। এ মুহূর্তে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের শাখা রয়েছে ১৫২টি। ৩৩টি উপ-শাখা ও ১৮৭টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটও চালু করা হয়েছে। প্রচলিত ধারার ব্যাংকিংয়ের
পাশাপাশি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিংও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এরই মধ্যে আমরা ৪৫টি শাখায় ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডো চালু করেছি। আগামীতে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের আরো বিস্তৃত পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।
ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বর্তমান নীতি কি?
শুরু থেকে মার্কেন্টাইল ব্যাংক করপোরেট খাতকে গুরুত্ব দিয়ে ঋণ বিতরণ করেছে। তবে গত কয়েক বছরে এ নীতির পরিবর্তন হয়েছে। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এখন আমরা কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কৃষি খাতে ব্যাংকের ঋণ বাড়ানোরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিওর প্রায় ২৫ শতাংশ এখন সিএসএমই। বাকি ৭৫ শতাংশ করপোরেট, কৃষিসহ অন্যান্য খাতের। কৃষিতে আমরা সাধ্যমতো অবদান রাখছি। প্রধানমন্ত্রী চাচ্ছেন গ্রামভিত্তিক অর্থনীতিকে সচল করতে। সে মূলনীতি সামনে রেখে আমরাও গ্রামভিত্তিক অর্থনীতি সচলে কাজ করছি। গ্রামের মানুষকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২ সালের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে তাদের মোট ঋণের ২৩ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে বিতরণের নির্দেশনা দিয়েছে। এছাড়া পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ, নতুন উদ্যোক্তাদের ঋণ দান এবং সেবা ও শিল্প খাতে ঋণ বিতরণের আলাদা লক্ষ্য থাকে। আমাদের ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ সিএমএসএমই খাতে অর্থায়নের বিষয়ে অত্যন্ত দায়িত্বশীল। লক্ষ্য অর্জনে পর্ষদ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও নীতিসহায়তা দেয়া হচ্ছে।
নারী উদ্যোক্তা তৈরির জন্য মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চলমান বিশেষ কর্মসূচির সাফল্য নিয়ে বলুন।
মার্কেন্টাইল ব্যাংক শুরু থেকেই নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে বিশেষ জোর দিয়ে আসছে। আমরা নানাভাবে চেষ্টা করছি নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে। বিশেষ করে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে নারীদের উৎসাহিত করছি। আমাদের মোট ফোর্টফোলিওর ৫ শতাংশ ঋণ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ। সামনে আমরা আরো বাড়ানো চেষ্টা করব।
সম্প্রতি নারী উদ্যোক্তা তৈরির জন্য আমরা খুলনায় একটি বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি। সেখানে নারী উদ্যোক্তাদের আমরা সরাসরি ঋণ দিয়েছি। বিশেষ এ কর্মসূচির কারণে সেখানকার নারীদের মধ্যে একটা জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা জুনে আরেকটি প্রোগ্রাম করব, যাতে তারা নিজেরা ঋণ নিতে পারেন এবং স্বাবলম্বী হতে পারেন। প্রচুর নারী উদ্যোক্তা নতুন করে এগিয়ে আসছেন। আমরা তাদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি।
নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের স্টার্ট-আপ প্রোগ্রামের অগ্রগতি সম্পর্কে জানাবেন?
বাংলাদেশ ব্যাংক স্টার্ট-আপদের বিষয়ে একটি সার্কুলার দিয়েছে। তারও আগে আমরা উদয়ন নামে একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। যদিও এটি আশানুরূপ হয়নি। তার পরও আমরা চেষ্টা করছি যাতে এটা আশানুরূপ হয়। আমরা আগে থেকেই সিকিউরিটি ছাড়া ঋণ দেয়ার চেষ্টা করেছি। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের শুরুতেই একটা প্রকল্প ছিল, যাতে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং গ্রাহক সহজে ঋণ নিতে পারেন। আমরা কোনো ধরনের সিকিউরিটি ছাড়া ঋণ দিতাম। এক্ষেত্রে শুধু গ্যারান্টারের প্রয়োজন হতো। পাশের দোকান ও মার্কেটের সভাপতি গ্যারান্টি দেবেন। আমরা এ ঋণ সফলভাবে দিয়েছি এবং এর আদায়ও বেশ ভালো।
শেষে জানতে চাই মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিকল্পনা সম্পর্কে।
শুরু থেকেই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মার্কেন্টাইল ব্যাংক সতর্কতার সঙ্গে এগিয়েছে। এ কারণে আমাদের খেলাপি ঋণের হার কখনই বিপৎসীমার ওপরে ওঠেনি। বর্তমানেও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশের নিচে। করোনাভাইরাস-সৃষ্ট দুর্যোগে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে শিথিলতা ছিল। এ কারণে ব্যাংকের ঋণ আদায়ে কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে। চলতি বছর আমরা খেলাপি ঋণ আদায় প্রক্রিয়া জোরদার করছি। নতুন ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে আমরা কৃষি ও সিএসএমই খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিকল্পনা সাজিয়েছি। অত্যাধুনিক ডিজিটাল পণ্য ও সেবার মাধ্যমে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সেবাকে আরো সহজতর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের জন্য শুভকামনা। সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে আপন দেশ। ধন্যবাদ।
আপন দেশসহ মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সম্মানীত গ্রাহক, শুভাকাঙ্খি ও শুভানুধ্যায়িদের প্রতি দুইযুগপূর্তির শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।ধন্যবাদ আপনাকে।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।