Apan Desh | আপন দেশ

চামড়ার ন্যায্য দাম মিলছে না অব্যবস্থাপনায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১০:৫২, ২ জুলাই ২০২৩

আপডেট: ১২:৪৭, ২ জুলাই ২০২৩

চামড়ার ন্যায্য দাম মিলছে না অব্যবস্থাপনায়

ফাইল ছবি

দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ রফতানি আয়ের খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বিশ্ববাজারে বিপুল চাহিদা। তারপরও অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্য দাম মিলছে না। দেশের কোথাও এবার  সরকারের বেঁধে দেয়া দাম পাননি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

এ বছর গরুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া ঢাকায় ৫০-৫৫ টাকা, ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট ৪৫-৪৮ টাকা নির্ধারণ করা হলেও সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে ৩০ টাকায়ও বিক্রি হয়নি।

চামড়ার দাম কমার কারণ হিসেবে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের দাবি, সাভারের চামড়া শিল্প নগরী পুরোপুরি আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স (অবশ্য পালনীয় শর্ত) অনুসরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায়  আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যে রফতানি করা যাচ্ছে না। কেমিক্যাল, লবণ ও শ্রমিক মজুরিকেও দায়ী করছেন তারা।

ঢাকা জেলা কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পোস্তার আড়তদাররা ও চামড়াশিল্পের মালিকরা দেশের জাতীয় সম্পদ কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণের নামে প্রতারণা করেছেন। যারা মাঠ পর্যায়ে চামড়া সংগ্রহ করেন তাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সভায় ডাকা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, ছাগলের মোট চামড়ার ২৫ শতাংশ  এবং গরুর মোট চামড়ার ১০ শতাংশ নষ্ট হয়েছে। ছাগলের চামড়া কেউ নেননি। এবার গরুর চামড়ার দর বর্গফুট ৫০ থেকে ৫৫ টাকা নির্ধারণ হলেও ৩০ টাকায়ও বিক্রি হয়নি। চামড়ার নির্ধারিত মূল্য বাস্তবায়নের কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় লবণযুক্ত চামড়ার নামে এক ধরনের প্রতারণা হয়েছে।

কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি আফতাব খান বলেন,  দেশের কাঁচা চামড়ার বড় বাজার পোস্তার আড়তদাররা গত তিন দিনে ৭০ হাজার পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়া রাজধানী ও আশপাশের অন্য বাজারগুলো থেকে আরও ৭০ হাজার পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে এবার এক কোটি ৪২ হাজার চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। এবার কাঁচা চামড়া তেমন নষ্ট হয়নি।  ঢাকায় ছয় লাখ পিস, বাকি চামড়া সারা দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে এসব চামড়া ঢাকায় আসবে ।

আরও পড়ুন <> গরুর চামড়া পানির দরে, ছাগলেরটা ফেলেছে ডাষ্টবিনে

এ বছর সারা দেশে পশু কোরবানি হয়েছে এক কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর ছয় শতাংশ হারে কোরবানির পশুর চামড়ার বাজার বাড়ে। সেই হিসাবে এবার কাঁচা চামড়ার বাজার প্রায় ৫০ কোটি টাকা বেড়ে ৮৭০ কোটি টাকা হবে। গত বছর কোরবানির বাজার ছিল ৮২০ কোটি টাকা।

বিটিএর তথ্য মতে, গত বছর (২০২২ সালে) আনুমানিক ৮২০ কোটি টাকার কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ৬০ লাখ গরুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়।  এসব চামড়ার প্রতি পিসের গড় মূল্য এক হাজার  টাকা। খাসি-বকরি ২০ লাখ পিস সংগ্রহ করা হয়, যার   প্রতি পিসের গড় মূল্য ছিল ১০০ টাকা। মহিষের কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয় পাঁচ লাখ পিস,  গড় মূল্য ছিল আড়াই হাজার  টাকা। ভেড়ার চামড়া সংগ্রহ করা হয় পাঁচ লাখ পিস, গড় মূল্য ছিল ১৫০ টাকা। ২০১৯ এবং ২০২০ সালে করোনাকালে কম  চামড়া সংগ্রহ করা হয়। 

বাংলাদেশ ট্যানার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ‘শনিবার পর্যন্ত ট্যানারিগুলো চার লাখ পিস গরুর চামড়া সংগ্রহ করেছে। এ বছর ৯০-৯৫ লাখ গরুর চামড়া সংগ্রহ করা হবে। লবণ ছাড়া ন্যূনতম দাম হবে ৮৫০ টাকা এবং লবণসহ প্রতি পিস এক হাজর ১৫০ টাকায় কেনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, লবণ ও লবণযুক্ত চামড়া নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি নেই। সরকারের নির্ধারিত দরেই চামড়া বেচাকেনা হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কয়েক বছর ধরে চামড়ার একটি ভিত্তিমূলক মূল্য ধরে রেখেছে। সেটির ওপর ভিত্তি করে মন্ত্রণালয় প্রতিবছর চামড়ার একটি মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এই মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়ার ভেতরে চামড়ার যে বাণিজ্যিক মূল্যের বিষয়টি রয়েছে, সেটি তেমন বিবেচনায় নেয়া হয় না। ফলে বাজারের ভিত্তিতে দরদাম করা এবং কাঁচামাল হিসেবে এর যে মূল্য থাকা উচিত, সে বিষয়গুলো এখানে উপেক্ষিত থেকে যায়। ফলে সব সময় এটির নিম্নমূল্য নির্ধারিত হয় এবং প্রকৃত বাজারমূল্য অনুসারে চামড়ার মূল্যায়ন হয় না।

তিনি বলেন, ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার মূল্য ৫০-৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে তা ৪৫-৪৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার সামান্য বাড়িয়ে বলা হয়েছে, ছয় শতাংশের মতো মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। অথচ এখন মূল্যস্ফীতি নয় দশমিক নয় শতাংশের মতো। সে বিবেচনা করলেও চামড়ার মূল্য হওয়ার কথা ছিল প্রতি বর্গফুট ৫২-৫৭ টাকা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে গরুর কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়, ঢাকায় লবণযুক্ত চামড়া প্রতি বর্গফুট ৪৭ থেকে ৫২ টাকা, আর ঢাকার বাইরের ৪০ থেকে ৪৪ টাকা। ২০২১ সালে নির্ধারণ করা হয় ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরু বা মহিষের চামড়া ৪০ থেকে ৪৫ টাকা; ২০২০ এই দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। ২০১৯ সালে গরুর কাঁচা চামড়া প্রতি বর্গফুট ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দর নির্ধারণ করা হয়েছিল।

গত শুক্রবার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় সারা দেশে মোট এক কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি পশু কোরবানি করা হয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে এবার সারা দেশে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল এক কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি। অর্থাৎ এ বছর ২৪ লাখ ৯৪ হাজার ৫২১টি পশু অবিক্রীত রয়ে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ মনে করেন, চামড়াশিল্পে যথাযথ সংস্কারের অভাব ও ট্যানারিগুলো আন্তর্জাতিক মান সনদ অর্জন না করায় স্থানীয় পর্যায়ে কাঁচা চামড়ার দাম বাড়ানো সম্ভব হয়নি। ফলে সরকার একটা দাম নির্ধারণ করে দিলেও শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক চামড়া বিক্রেতারা উপযুক্ত দাম পান না। তিনি বলেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এই খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনলে কাঁচা চামড়ার চাহিদা বাড়বে ও স্থানীয় পর্যায়ে দামও বাড়বে।

সরবরাহ বেশি থাকায় এবার চামড়ার দাম কিছুটা কম ছিল বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ। শনিবার ফরিদপুর শহরের চামড়া বাজার ও গোডাউন পরিদর্শন শেষে তিনি এ কথা বলেন। বাণিজ্য সচিব বলেন, এবার সীমান্তে বিজিবির কঠোর নজরদারি ছিল। যার কারণে চামড়া পাচার হয়নি। আর কোরবানির সময় চামড়ার বেশি সরবরাহের কারণে দাম কিছুটা কম ছিল।

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়