ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ নারী পুরুষ ও আত্মহত্যা করেন, অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন নারী বা পুরুষ আত্মহত্যা করছেন। এ লেখাটি যখন পাঠক পড়ছেন তখন হয়তো ১০ জন আত্মহত্যা করে ফেলেছেন। আর প্রায় ৪০ জনের বেশি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, প্রতি বছরই এ হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সাধারণত দরিদ্র দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার বেশি হলেও উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে জাপানে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি।
বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন (১ মিলিয়ন=১০ লাখ) ডিপ্রেশনের (বিষণ্ণতা) রোগী রয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ৫ জনের ১ জন কোনো না কোনো ধরনের ডিপ্রেশনে ভুগছেন। পরিবারের অনেকে জানেনই না যে, তাদের কোনো স্বজন ডিপ্রেশনে ভুগছেন। সমাজে ডিপ্রেশন সম্পর্কে রয়েছে ব্যাপক অজ্ঞতা, অসচেতনতা।
তরুণদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ বিষণ্ণতাজনিত আত্মহত্যা
ডিপ্রেশনের ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে রোগী নীরবে-নিভৃতে নিজেকে শেষ করে দেয়ার (আত্মহত্যা) পথ বেছে নেন। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ এ ডিপ্রেশনজনিত আত্মহত্যা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশে আত্মহত্যা করেছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ। বিবিএস’র জরিপ বলছে, বাংলাদেশে বছরে আত্মহত্যা করছেন প্রায় ১৩ হাজার মানুষ। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে ঝিনাইদহে।
হটাৎ আত্মহত্যার কারণ
সাধারণত কিশোর-কিশোরীদের (টিনএজ) মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। আত্মহত্যার পেছনের অন্যতম কারণ ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা, একাকিত্ব, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, দারিদ্র্য, সামাজিক বৈষম্য, বেকারত্ব, দাম্পত্য কলহ, সম্পর্কে টানাপোড়েন, অভাব-অনটন, দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ও মানসিক রোগ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহ, মাদকাসক্তি, প্ররোচনা, হঠাৎ রেগে গিয়ে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো এবং দৈহিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন।
আত্মহত্যার চেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করার পরিসংখ্যান বহুগুণ বেশি। কেউ একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করলে, আত্মহত্যার কথা বললে কিংবা আত্মহত্যার চিন্তা করলে তার মধ্যে এ দুর্ঘটনা ঘটানোর শঙ্কা অনেক অনেক বেশি থাকে।
তাই এ লক্ষণ থাকলে তা অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে এবং দ্রুততম সময়ে সাইকিয়াট্রিস্ট বা সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে।
বিষণ্ণতাজনিত আত্মহত্যা কী?
ডিপ্রেশন (বিষণ্ণতা) একটি ভয়ানক মানসিক ব্যাধি। মানুষের শারীরিক ও মানসিক কর্মক্ষমতা, দক্ষতা কমে যায় এ স্বাস্থ্য সংকটে। ডায়াবেটিস ও হাইপ্রেশারের রোগীর মধ্যে যেমন ডিপ্রেশন দেখা দেয়, তেমনি উল্টোটাও হয়ে থাকে। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, সন্তানসম্ভবা কিংবা প্রসূতি—যে কারোরই ডিপ্রেশন হতে পারে, যা থেকে তারা একপর্যায়ে আত্মহত্যা করে বসে।
বিষণ্ণতায় ভুগতেন যেসব মহামানব
যে কারোরই ডিপ্রেশন হতে পারে। বিশ্বের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন। তাদের মধ্যে চাঁদে ভ্রমণকারী এডুইন অলড্রিন, প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, উইস্টন চার্চিল, বিখ্যাত ‘হেরি পোর্টারের লিখিকা জে কে রওলিং, গ্রেমি এওয়ার্ড খেতাবপ্রাপ্ত গায়িকা শেরিল ক্রো, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের স্ত্রীর নাম উল্লেখযোগ্য।
মার্কিন নভোচারী অলড্রিনের দাদিও ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন, যিনি এ অবস্থায় আত্মহত্যা করেন। হেরি পোর্টারের লেখিকা রোওলিং ডিপ্রেশনের জন্য মাঝেমধ্যে আত্মহত্যার কথা ভাবতেন। তবে তারা সবাই নিয়মিত সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে আলোচনা করতেন।
ডিপ্রেশনের কিছু লক্ষণ
♦ সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকা, উৎসাহ উদ্যম হারিয়ে ফেলা
♦ ঘুম কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
♦ রুচি কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
♦ কাজকর্মে শক্তি না পাওয়া, মনোযোগ হারিয়ে ফেলা
♦ মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া
♦ নিজেকে নিঃস্ব অপাঙক্তেয় মনে করা
♦ আত্মহত্যার কথা বলা, ভাবা, চেষ্টা করা
এ লক্ষণগুলো টানা দু’সপ্তাহের বেশি থাকলে আমরা তাকে মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসওয়ার্ডারের রোগী বলি এবং তাকে আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছেন বলে বলা যায়।
চিকিৎসা
সাইকিয়াট্রিস্টের তত্ত্বাবধানে থেকে নানান প্রকারের কার্যকরী এন্টিডিপ্রেসেন্ট ড্রাগ, সাইকোথেরাপি ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে একজন ডিপ্রেশনের রোগীকে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। সাধারণত সারট্রালিন, এমিট্রিপটাইলিন, সিটালোপ্রাম, এস-সিটালোপ্রাম, মিরটাজাপিন এন্টিডিপ্রেসেন্ট হিসেবে খুবই কার্যকরী।
সারা বিশ্বে ক্রমবর্ধমান ডিপ্রেশনের এ ভয়াবহতা উপলব্ধি করেই ২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান করা ছিল—‘ডিপ্রেশন: লেট'স টক’ অর্থাৎ ‘আসুন, ডিপ্রেশন নিয়ে আলোচনা করি’। ডিপ্রেশন নিয়ে লজ্জা নয়। বিষণ্ণতা নিয়ে সচেতনতা প্রয়োজন। বিষণ্ণ রোগীর প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিন, তাদের সঙ্গে ডিপ্রেশন নিয়ে আলাপ করুন এবং তাদের চিকিৎসার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিন।
লেখক: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কলামিস্ট ও জনস্বাস্থ্য গবেষক।
আপন দেশ/এসএমএ