ছবি: সংগৃহীত
আফ্রিকার দেশ লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েল। ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে পূর্বাঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে দেশটির উপকূলীয় শহরগুলোর শতশত বাড়ি উড়ে গেছে। এ ছাড়া দুটি পুরনো বাঁধ ভেঙে গিয়ে দারনা শহরে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। আর এই বন্যায় দারনা শহর পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ঝড় ও বন্যায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন অন্তত পাঁচ হাজার ৩০০ মানুষ। নিখোঁজ রয়েছেন কয়েক হাজার।
মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম হতাহতের খবর জানিয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, পুরো দারনা শহরই ভেসে গেছে। বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহরটির অ্যাম্বুলেন্স সোসাইটি জানিয়েছে, শুধুমাত্র দারনা শহরেই দুই হাজার ৩০০ লোক নিহত হয়েছেন।
দারনার এক উদ্ধারকারী জানিয়েছেন, সেখানকার হাসপাতালগুলোতে এখন আর চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া মর্গগুলোও মরদেহে ভরে গেছে।
লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের স্বঘোষিত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তারেক আল খারাজ জানিয়েছেন, ভয়াবহ এই বন্যার পানিতে ডুবে বা ভেসে গিয়ে এখন পর্যন্ত প্রাণহানি হয়েছে পাঁচ হাজার ২০০ লোকের। অবশ্য তার এই মন্তব্যের পর আরও ১০০ লোকের প্রাণহানির খবর এসেছে।
আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, বন্যায় ১০ হাজার লোককে সমুদ্রের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর লিবিয়ায় দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেন ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে সবকিছু। ধসে গেছে রাস্তা-ঘাট। পানির স্রোতে ভেসে গেছে অসংখ্য গাড়ি।
বাড়ি-ঘর ও রাস্তা-ঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন অঞ্চলটির বাসিন্দারা। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যাও। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। এ অবস্থায় অঞ্চলটির স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী ওসামা হামাদ বহু মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন।
সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েলের প্রভাবে দেশটির বেনগাজি, সোসি, আল বায়দা, আল মারজ এবং দারনা শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় বন্যার পানি সরে গেলেও উপকূলীয় শহর দারনায় পানির স্তর বিপৎসীমার ১০ ফুট উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাঁধের পানির কারণে সৃষ্ট বন্যা হাজারো মানুষকে সমুদ্রের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সেই বন্যাটিকে অনেকে সুনামির মতো আখ্যায়িত করেছেন। সমুদ্রের পানিতে যেসব মানুষ ভেসে গেছেন তাদের মরদেহ পানি থেকে উদ্ধার করতে হিমশিম খাচ্ছেন উদ্ধারকারীরা।
বন্যার ভয়াবহতা তুলে ধরে বেনগাজিভিত্তিক পূর্বাঞ্চলীয় সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওথমান আব্দুল জলিল আলমাসার টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তিনি বলেন, দারনা এখন এক ভূতের নগরী। সেখানে পরিস্থিতি বিপর্যয়কর। যত্রতত্র মরদেহ পড়ে আছে। অনেক লোক বন্যায় ধসে পড়া ঘরের ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়ে আছে। অনেকে ঘর থেকে বের হতে পারছে না। তিনি জানান, শুধু দারনাতেই ছয় হাজার মানুষ নিখোঁজ আছে।
প্রলয়ংকরী বন্যার কারণ প্রসঙ্গে ইউএস লিবিয়া রিলেশনস বিষয়ক ন্যাশনাল কাউন্সিলের সদস্য হানি শেনিব বলেন, ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েলের কারণে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তা ধারণ করতে পারেনি জলাধার দুটি। এতে লাখ লাখ কিউবিক মিটার পানি দারনাসহ পুরো পূর্বাঞ্চলের তীব্র বেগে ছড়িয়ে পড়ে। জলাধারের কাছাকাছি হওয়ায় দারনার চার কিলোমিটার এলাকা একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন <> মরক্কোতে গৃহহীনরা আশ্রয়ের খোঁজে, নিহত বেড়ে ২৯০০
চলমান পরিস্থিতিতে জরুরি সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির লিবিয়া বিষয়ক মানবাধিকার সমন্বয়ক জর্জেট্টি গ্যাগনন জানান, তাদের কাছে দেশটির গ্রাম ও শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর রয়েছে। অবকাঠামোর পাশাপাশি বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন জরুরি ভিত্তিতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়।
এরই মধ্যে তুরস্ক তাদের একটি উদ্ধারকারী দলকে লিবিয়ায় পাঠিয়েছে। আর মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ সিসি উদ্ধারকাজে অংশ নেয়ার জন্য সেনাসদস্যদের পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এক টেলিভিশন ভাষণে তিনি এ ঘোষণা দেন। এ ছাড়া জার্মানি, ইরান, ইতালি ত্রাণ সহায়তা দেয়ার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে।
দেশটির দুর্গত মানুষের জন্য বাংলাদেশও ওষুধ ও শুকনো খাবারসহ ত্রাণসামগ্রী পাঠাচ্ছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে আব্দুল মোমেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বাংলাদেশের সি-১৩০ এয়ারক্রাফট শিগগিরই ঢাকা থেকে যাত্রা করবে বলে জানা গেছে।
বিবিসি আরও জানিয়েছে, এই ভয়াবহ বিপদে যারা পড়েছেন তাদের যে উদ্ধার করা হবে সেই পরিস্থিতিও এখন লিবিয়ায় নেই। কারণ ২০১১ সালে সাবেক শাসক কর্নেল মোহাম্মদ গাদ্দাফিকে হত্যার পর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মুখে পড়ে দেশটি। আর তখন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দেশটিতে শুধুমাত্র যুদ্ধই চলেছে। ফলে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিলে- বিপর্যয় পরবর্তী বিষয়াবলী যে সামাল দেয়া হবে এমন কোনো বাহিনী বা অবকাঠামোই তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
এ ছাড়া গাদ্দাফির পতনের পর গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে যায় লিবিয়া। এর ফলে বর্তমানে দেশটি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এখন পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল আলাদা আলাদাভাবে শাসিত হয়ে আসছে। আর বিভক্তির কারণে কেন্দ্রীয় ও সমন্বিত কোনো উদ্ধার অভিযানও সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় প্রাণহানির ঘটনায় তিন দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। নিখোঁজদের উদ্ধারে চলছে অভিযান। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে স্কুল কলেজ ও দোকানপাট। এ ছাড়া দেশটির প্রধান চারটি বন্দর সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
আপন দেশ/আরএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।