ছবি : সংগৃহীত
সিরিয়ার দামেস্কে অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলায় সাত সেনা কমান্ডারসহ ১১ জন নিহতের ঘটনার জবাব দেবে ইরান। মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এ হুমকি দিয়েছেন।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইব্রাহিম রাইসি বলেছেন, ‘প্রতিরোধ অক্ষের ইচ্ছাশক্তিকে দমন করতে না পেরে ইহুদিবাদী ওই রাষ্ট্র (ইসরায়েল) আবারো গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে। এটি অবশ্যই তাদের মনে রাখা উচিত যে তাদের লক্ষ্য কখনো পূরণ হওয়ার নয়। আর কাপুরুষোচিত এই অপরাধের অবশ্যই জবাব দেয়া হবে।’
সোমবার (১ এপ্রিল) সিরিয়ার দামেস্কে অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেটে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এ হামলায় নিহত ১১ জনের মধ্যে সাত জনই ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর-আইআরজিসি) সদস্য।
আইআরজিসি বলছে, হামলায় তাদের যে সাত সদস্য নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে দুজন শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার ছিলেন। তারা হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজা জাহেদি ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাদি হাজি রাহিমি।
এদিকে ইসরায়েল বলেছে, ওই হামলার খবরের ব্যাপারে তারা কোনো মন্তব্য করবে না। তবে রয়টার্স জানিয়েছে, সোমবার রাতে ইরানের অন্যতম সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পরিষদ সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল বৈঠকে মিলিত হয়ে দামেস্কে ইসরায়েলের প্রাণঘাতী হামলার বিষয়ে ‘প্রয়োজনীয়’ জবাব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে ইরান ইসরায়েল ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ানোর মতো বিপজ্জনক ঝুঁকি নেবে কিনা তা পরিষ্কার হয়নি। সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে করা এক প্রতিবেদনে অ্যাক্সিওস জানিয়েছে, ইরানকে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে তারা দামেস্কের কূটনৈতিক কম্পাউন্ডে ইসরায়েলি হামলার সঙ্গে ‘জড়িত ছিল না’ এবং এ হামলার বিষয়ে আগাম কোনো খবরও তাদের কাছে ছিল না।
ইরান যদি ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের পথ এড়িয়ে যায় তাহলে তেহরান লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতিদের মতো তাদের ছায়া বাহিনীগুলোর ওপর নির্ভর করে পাল্টা হামলা চালাতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
ইসরায়েল অনেকদিন ধরেই সিরিয়ায় ইরানের সামরিক স্থাপনা ও তাদের ছায়া বাহিনীগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে আসছিল। কিন্তু সোমবার প্রথমবারের মতো ইসরায়েলি বাহিনী ইরানের দূতাবাস কম্পাউন্ডে হামলা চালালো।
সিরিয়ায় নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত হোসেইন আকবরি এ হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইরানের জবাব ‘দ্রুত ও যথাযথ’ হবে। গাজায় চলমান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে এমনিতেই ইসরায়েলের সঙ্গে ইরান ও মিত্রদেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা চলছে। সোমবারের ঘটনার পর এ উত্তেজনা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সিরিয়ান অবজারভেটরির প্রধান রামি আবদেল রহমান এএফপিকে বলেন, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আটজন ইরানের, দুজন সিরিয়ার ও একজন লেবাননের নাগরিক। তারা সবাই যোদ্ধা, কেউই বেসামরিক নাগরিক নন।
সিরিয়ায় নিযুক্ত ইরানি দূত হোসেন আকবরি অবশ্য নিহত ব্যক্তির সংখ্যা আরও কম বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান দিয়ে চালানো ওই হামলায় কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। যুদ্ধবিমান থেকে ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছিল।
সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, হামলায় পুরো ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। ভবনের ভেতর যারা ছিলেন, তারা সবাই হতাহত হয়েছেন। মৃতদেহগুলো উদ্ধার ও আহত ব্যক্তিদের ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনার কাজ চলছে।
খবরে বলা হয়েছে, সিরিয়ার দামেস্কে মেজেহ অঞ্চলে অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট। সেখানে দেখা গেছে, পুরো ভবনটি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে শুধু ধোয়া বেরিয়ে আসছে। বাইরে অবস্থান নিয়েছে ইমার্জেন্সি বিভাগের গাড়ি।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান এই হামলাকে ‘সব ধরনের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা ও চুক্তির লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করেছেন। কনস্যুলেট ভবনে হামলার ঘটনায় ইসরায়েল জড়িত বলে দাবি করেছেন তিনি।
পৃথক এক বিবৃতিতে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি বলেছেন, ইরানের প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকার রয়েছে। আর এই প্রতিক্রিয়ার ধরন ও হামলার শাস্তি সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে তেহরান।
জাতিসংঘে ইরানের মিশন বলেছে, এই হামলার ঘটনাটি জাতিসংঘের সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং কূটনৈতিক ও কনস্যুলার চত্বর রক্ষার মূলনীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন। অন্যদিকে, হামলার নিন্দা জানাতে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানি মিশন সংস্থাটির নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
সিরিয়ায় কনস্যুলেট ভবনে ইসরায়েলি হামলার ঘটনার পরপরই তেহরানের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন হাজার হাজার মানুষ। তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দেশটির ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন <> তুরস্কে আবাসিক ভবনে আগুন, নিহত ১৫
ইরানের অন্যতম মিত্র সিরিয়া বলেছে, ইসরায়েলি হামলায় নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। হামলার পরপরই ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল মেকদাদ। তিনি বলেছেন, আমরা দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবন লক্ষ্য করে চালানো এই নৃশংস সন্ত্রাসী হামলা ও নিরপরাধ মানুষকে হত্যার তীব্র নিন্দা জানাই।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের মিত্র রাশিয়াও ইরানি কনস্যুলেটে হামলার নিন্দা জানিয়েছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমরা সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলার মিশনের বিরুদ্ধে এই অগ্রহণযোগ্য হামলার তীব্র নিন্দা জানাই।
লেবাননের ইরান-সমর্থিত শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, দামেস্কে হামলার ঘটনায় ইসরায়েলকে চড়া মূল্য দিতে হবে। গত ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে হামাসের সমর্থনে ইসরায়েলে প্রায় প্রতিদিনই হামলা চালিয়ে আসছে হিজবুল্লাহ।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ বলেছে, ‘এই অপরাধের জন্য শত্রুপক্ষকে শাস্তি পেতে হবে। অবশ্যই হামলার প্রতিশোধ নেয়া হবে।’ ইরাক, জর্ডান, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অন্যান্য মুসলিম দেশও এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে।
এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার সাংবাদিকদের বলেছেন, ওয়াশিংটন ওই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান সংঘাত বৃদ্ধির কারণ হতে পারে এমন যেকোনো বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন রয়েছে।
হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্তব্য করি না। তবে মার্কিন প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্তত চারজন ইসরায়েলি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে। তারা স্বীকার করেছে, দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলার ঘটনায় ইসরায়েল জড়িত।
ইসরায়েল যে ইরানের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের লক্ষ্যবস্তু করছে, কনস্যুলেট ভবনে হামলার ঘটনায় সেটি মনে হচ্ছে। কারণ দেশটির সামরিক বাহিনী গাজা ও লেবাননের সঙ্গে সীমান্তে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত গোষ্ঠীগুলোকে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করে। তবে বিশ্লেষকরা এই হামলার ঘটনাটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু করতে পারে কিনা তা নিয়ে বিভক্ত।
ওয়াশিংটন ডিসির সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জন অল্টারম্যান বলেছেন, ইসরায়েল সম্ভবত এই হামলাকে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে।
হামলার লক্ষ্যবস্তু হওয়া ভবনটি ইরানি দূতাবাসের পাশে অবস্থিত। এর সামনের অংশে কাসেম সোলাইমানির একটি বড় ছবি লাগানো। সোলাইমানিকে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সামরিক কর্মকাণ্ডের স্থপতি বলা হয়ে থাকে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ইরাকে মার্কিন ড্রোন হামলায় সোলাইমানি নিহত হন।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।