ছবি : সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত চলছে। একটি মুসলিমপ্রধান দেশ ও অন্যটি ইহুদিবাদী দেশ। ফলে দেশ দুটির মধ্যে বৈরিতা অনেকদিনের। এর মূলে রয়েছে ফিলিস্তিন ইস্যু। এখন ইরান-ইসরায়েল পারস্পরিক হামলা ও পাল্টা হামলার শঙ্কায় রয়েছে পুরো বিশ্ব।
ঘটনার সাম্প্রতিক সূত্রপাত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) বোমা হামলা থেকে। ওই বিমান হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ডের সাত সদস্য এবং ছয় সিরীয় নাগরিক নিহত হন।
তবে কনস্যুলেটে হামলা চালানোর কথা স্বীকার করেনি ইসরায়েল, তবে এর পিছনে তাদের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর জবাব দিতে গত শনি ও রোববার ইসরায়েলে ৩০০ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)। অবশ্য ইসরায়েল এ হামলা সফলভাবে প্রতিহত করার দাবি তুলছে। এই প্রথম ইসরায়েলের ভূখণ্ডে হামলা চালায় ইরান।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলের সঙ্গে চরম দ্বন্দ্ব রয়েছে ইরানের। সেই দ্বন্দ্ব আরও ব্যাপকভাবে বেড়েছে গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরুর পর থেকে।
সর্বশেষ ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বলেছেন, ইরানের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেকোনো পদক্ষেপের কঠোর জবাব দেয়া হবে। ইরানি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলের হুমকির একদিন পর মঙ্গলবার তিনি এ কথা বলেছেন। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করছি, এমনকি ক্ষুদ্র ইরানি স্বার্থের বিরুদ্ধে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর, বিস্তৃত ও বেদনাদায়ক জবাব দেয়া হবে।
ইব্রাহিম রাইসি টেলিফোনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও কথা বলেছেন। আলাপে রাইসি বলেছেন, ইসরায়েলের ওপর তেহরানের হামলা ছিল সীমিত আকারে এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান উত্তেজনা বাড়াতে আগ্রহী নয়।
এদিকে ক্রেমলিন বলছে, পুতিন আশা প্রকাশ করেছেন, সব পক্ষই যুক্তিসঙ্গত সংযম দেখাবে এবং সংঘাতের পতন রোধ করবে। সংঘাত পুরো অঞ্চলের জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট।
ইরান ও রাশিয়া ঘনিষ্ঠ মিত্র। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে তেহরান মস্কোকে যে সামরিক সহায়তা দিয়েছে তার বিনিময়ে রাশিয়া ইরানের আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও যুদ্ধবিমান উন্নত করতে সহযোগিতা করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে জরুরি ভিত্তিতে পাকিস্তান সফরে যাচ্ছেন ইব্রাহিম রাইসি। ইতোমধ্যেই ইসলামাবাদ ও তেহরান প্রেসিডেন্ট রাইসির এ সফরের ব্যাপারে একমত হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে রাইসির এ সফর আগামী ২২ এপ্রিল হতে পারে বলে জানিয়েছেন ইরানের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ইরানের রাজনীতিবিষয়ক উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আলি বাঘেরি কানিও ইসরায়েল হামলা চালালে পাল্টা হামলার হুমকি দিয়েছেন। মঙ্গলবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম এবিসি নিউজের প্রতিবেদনে জানানো হয়। আলি বাঘেরি কানি বলেন, ইসরায়েল যদি পাল্টা হামলা চালায়, ইরান কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জবাব দেবে।
অন্যদিকে ইরানের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা দিতে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্টয মঙ্গলবার বলেছেন, তিনি দেশগুলোকে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্য এবং দেশটির রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসকে (আইআরজিসি) সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। খবর রয়টার্সের।
তিনি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে বলেছেন, ‘মিসাইল ও ড্রোন হামলার সামরিক প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি, আমি ইরানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছি।’ কার্টয বলেছেন, তিনি ৩২টি দেশে চিঠি পাঠিয়েছেন এবং অসংখ্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন যাতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পাশাপাশি ইরানকে থামাতে এবং দুর্বল করতে বিপ্লবী গার্ডকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখনই ইরানকে থামাতে হবে, অনেক দেরি হওয়ার আগে।’
এদিকে রেভল্যুশনারি গার্ডকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করা হবে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক এবং মতভেদ আছে। কেউ কেউ এমন পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষে, আবার অন্যরা এর বিপক্ষে। কারণ, আইআরজিসি কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নয় বরং ইরানের অংশ। এর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে ইরান যোগাযোগের চ্যানেল বন্ধ করে দিতে পারে।
ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার শঙ্কা বাড়িয়ে দেয় গত সোমবার অনুষ্ঠিত ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর। ইরানের হামলার পাল্টা জবাব দিতে বৈঠকে বসেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সেখানেই পাল্টা হামলা চালানোর সিদ্ধান্তের কথা জানা যায়।
আরও পড়ুন <> ইসরায়েলি হামলায় সেকেন্ডের মধ্যে জবাব দেবে ইরান
মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত বৃদ্ধির আশঙ্কা ও সংযমের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও ইরানের হামলার জবাব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসরায়েল। সোমবার বিকালে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সপ্তাহান্তে ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলার প্রতিক্রিয়া জানাতে ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে সোমবার দ্বিতীয়বারের মতো যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা তলব করেন নেতানিয়াহু। ওই সভাতেই সিদ্ধান্ত হয় যে, ইরানের ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার জবাব দেয়া হবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের নজিরবিহীন হামলার ঘটনায় সীমিত আকারে প্রতিক্রিয়া দেখাবে জেরুজালেম। খুব সম্ভবত, ইরানের বাইরে ইরান-সমর্থিত বাহিনীগুলোর কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলা হতে পারে। মঙ্গলবার ইসরায়েলের গণমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল এই তথ্য জানিয়েছে।
এনবিসিকে অন্তত চার মার্কিন কর্র্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এই ধারণা পেয়েছেন। যেহেতু তেহরানের হামলায় তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, সে ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম আগ্রাসী মনোভাব দেখাবে জেরুজালেম।
ইসরায়েলের মিত্ররা দেশটিকে ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি হামলা চালানোর বিষয়ে সতর্ক করেছে। তারা জানিয়েছে, এ ধরনের উদ্যোগে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে সিরিয়ার আধা-সামরিক বাহিনী বা লেবাননের সশস্ত্র বাহিনী হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে হামলা আসতে পারে। উভয় সংগঠনই ইরানের কাছ থেকে সরাসরি সমর্থন পেয়ে থাকে।
চার কর্মকর্তার বরাত দিয়ে এনবিসি আরও জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা, এ বিষয়ে সব সিদ্ধান্তের বিষয়ে ইসরায়েল ওয়াশিংটনকে অবহিত রাখবে। তবে কোনো ধরনের প্রতিশোধমূলক পাল্টা হামলা বা সামরিক প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেবে না।
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে দেশটির শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক চলে আসছে। ইরান ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকার স্বীকার করে না এবং ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে চায়। ওদিকে, ইসরায়েলও তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসাবেই দেখে ইরানকে।
ছয় মাস আগে গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী গোষ্ঠী হামাসকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করে আসা ইরানে হামলা বাড়িয়েছে ইসরায়েল।
ইরান এর প্রতিশোধমূলক জবাব দেওয়ার পর এখন সামরিকভাবে পাল্টা জবাব দেওয়ার চিন্তাভাবনা করার পাশাপাশি কূটনৈতিক দিক থেকেও ইরানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টায় আছে ইসরায়েল।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ওপর জাতিসংঘের আরোপিত কয়েকদফা নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত অক্টোবরে। তারপরও ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউ। নতুন আরও নিষেধাজ্ঞাও তারা আরোপ করছে।
সব মিলিয়ে যেকোনো সময় ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা শুরুর শঙ্কা ফেলে দেয়া যাচ্ছে না। এমনটি হলে মধ্যপ্রাচ্য খুব বেশি অশান্ত হয়ে পড়বে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ইরানে হামলা করলে পাশে না থাকার কথা জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে তা নির্ভর করছে এখন ইসরায়েল কী প্রতিক্রিয়া দেখায় তার ওপর।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।