ফাইল ছবি
ভারতে নিবন্ধিত ২০টিরও বেশি ভাষায় প্রায় ৪০০ নিউজ চ্যানেল রয়েছে। দৈনিক সংবাদপত্রের প্রকাশনা রয়েছে ২০ হাজারেরও বেশি। তবে অনেক বিশ্লেষকের মতে, এত বেশি সংবাদমাধ্যম থাকলেও ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ’ খ্যাত ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই বললেই চলে।
আন্তর্জাতিক নজরদারি সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের সূচক অনুসারে, ২০১৪ সালে মোদি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তখন ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ছিল ১৪০তম। আর ২০২৪ সালে তা ১৫৯তম স্থানে নেমে এসেছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ভারতের এ অবস্থানের অন্যতম কারণ, দেশটির বিশিষ্ট মিডিয়া গ্রুপগুলোর মালিকানা কেন্দ্রীভূত। যেমন, অর্ধশতাধিক সংবাদমাধ্যমের মালিক রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান; যিনি প্রধানমন্ত্রী মোদির ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের অধীনে ভারতে ৬০টিরও বেশি সংবাদমাধ্যম রয়েছে। আর এভাবেই সংবাদমাধ্যম ও তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে যেমন একত্রিত হয়েছে, তেমনই সমালোচনামূলক প্রতিবেদনের সংখ্যাও কমে আসছে।
ভারতে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো অন্যান্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মগুলোও জনপ্রিয়। তবে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো থেকে যারা দূরে থাকেন তারা বেশিরভাগই ইউটিউবকে বেশি পছন্দ করেন। বর্তমানে দেশটিতে ৪৬০ মিলিয়নেরও বেশি ইউটিউব ব্যবহারকারী রয়েছেন। দেশটির প্রতি পাঁচজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে চারজন ইউটিউব ব্যবহারে বেশি আগ্রহী।
আরও পড়ুন>> আহমাদিনেজাদ কেন প্রেসিডেন্ট হতে চান?
এমন পরিস্থিতিতে ভারতের বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও সাধারণ নাগরিক ইউটিউবকে বেছে নিয়েছেন নিজেদের মত প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। তেমনই একজন রবীশ কুমার। একজন জাঁদরেল সাংবাদিক ও উপস্থাপক। জিতেছেন এশিয়ার নোবেলখ্যাত মর্যাদাপূর্ণ ম্যাগসেসে পুরস্কার।
দীর্ঘদিন ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির উপস্থাপক ছিলেন রবীশ কুমার। তবে ২০২২ সালের শেষের দিকে দেশটির অন্যতম ধনকুবের গৌতম আদানি যখন এনডিটিভির মালিকানা কিনে নেন, তখন তিনি এনডিটিভির চাকরি ছেড়ে দেন। কারণ গৌতম আদানি মোদির বেশ ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত।
এনডিটিভি ছাড়ার পর সাংবাদিক হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ করা শুরু করেন রবীশ। ইউটিউবে তার নিজস্ব একটি চ্যানেল রয়েছে। সেই চ্যানেলে তার এখন ১ কোটিরও বেশি সাবস্ক্রাইবার। যেখান থেকে প্রতি সপ্তাহে ২ কোটিরও বেশি ভিউ পান তিনি। ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মটি বর্তমানে ভিন্নমতের কারণে কোণঠাসা হওয়া সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে।
ভারতের আরও একজন ইউটিউবার সম্প্রতি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। ২৯ বছর বয়সি ধ্রুব রাঠীর প্রায় ২ কোটি সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। তার ইউটিউব চ্যানেলটি এ মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল। সম্প্রতি তিনি একটি ভিডিও আপলোড করেন যেখানে তিনি বলেন, ভারত এখন একনায়কতন্ত্রের কবলে চলে গেছে। মাত্র এক মাসে সেই ভিডিওটি ৩ কোটি ২০ বার দেখা হয়েছে।
এছাড়াও অন্যান্য অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও সাবেক টিভি উপস্থাপক, যেমন পুণ্য প্রসূন বাজপাই, অভিসার শর্মা এবং অজিত আঞ্জুমও ইউটিউবে বহু দর্শক-শ্রোতা নিয়ে অনুষ্ঠান হোস্ট করেন।
আরও পড়ুন>> ভারতকে নিষেধাজ্ঞার হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের
ভারতীয় ইউটিউবাররা নিজেদের এ সাফল্যের জন্য তিনটি কারণ উল্লেখ করে থাকেন। প্রথমত, ইউটিউবের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো আয়ত্ত করা। সাধারণত ধ্রুব রাঠির ভিডিওগুলো ২০-৩০ মিনিটের হয়ে থাকে। তিনি যেকোনো বিষয়কে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন।
রাঠীর ভিডিওগুলোতে প্রায়ই চটকদার অ্যানিমেশন, চার্ট ও সংবাদমাধ্যমের ভিডিও ক্লিপ থাকে। তিনি প্রায়ই প্রধানমন্ত্রী মোদিকে দুর্নীতির কেলেঙ্কারি ও বিভিন্ন বিতর্কের সঙ্গে জড়িয়ে ভিডিও পোস্ট করে থাকেন; যা মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো কঠোরভাবে এড়িয়ে চলে। সম্প্রতি তিনি একটি ভিডিওতে মোদিকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
দ্বিতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়ার অত্যাধুনিক ব্যবহার। যদিও ইউটিউব তাদের প্রধান প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু ভিন্ন ধারার এ ইউটিউবারদের অন্যান্য মাধ্যমেও অনেক বেশি অনুসারী রয়েছে। ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকে ধ্রুব’র প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ফলোয়ার আছে আর রবীশ কুমারের আছে প্রায় ৯০ লাখ।
তৃতীয় ও সবশেষ কারণ হলো দর্শক চাহিদা। বেশিরভাগ ভারতীয় সংবাদ চ্যানেল প্রায় একইরকম সংবাদ পরিবেশন করে। যার ফলে এ ধরণের ভিন্ন ধারার কন্টেন্টের চাহিদা অনেক বেশি।
তবে ইউটিউবে তারা স্বাধীনতা ভোগ করছেন, তারও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এসব ভিডিও তৈরির জন্য ইউটিউবারদের অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। যেমন ধ্রুব রাঠীর ভিডিও তৈরির জন্য ১৫ জনের গবেষণার একটি দল রয়েছে।
অন্যদিকে রবীশ কুমার একটি ভিডিওর জন্য দিনে ১৫ ঘণ্টা লেখালেখি, ভিডিও ও শুটিংয়ের পেছনে ব্যয় করেন। অনলাইনে ইউটিউবারদের অগ্রগতি চিত্তাকর্ষক হলেও, তাদের দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা মূলধারার গণমাধ্যমের চেয়ে অনেক কম।
তা সত্ত্বেও তাদের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করছে মোদি সরকার। গত বছর সরকার এমন একাধিক আইন পাস করেছে যার মাধ্যমে ইন্টারনেট কোথায়, কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে; তা ব্যাপকভাবে নজরদারি করা হচ্ছে।
ক্যাবল টেলিভিশন নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন একটি সম্প্রচার আইন তৈরি করা হচ্ছে যাতে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সংবাদ পর্যবেক্ষণের মতো বিষয়গুলো রয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনটি সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য স্বাধীন ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমগুলো একটি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ গঠন করেছে। তবে ইউটিউবারদের তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। সরকার এ ইউটিউবারদের মুখ বন্ধ করানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। গুগুল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তারা গত বছর ইউটিউব থেকে ২ হাজার ১০০টিরও বেশি কন্টেন্ট সরিয়ে ফেলার অনুরোধ পেয়েছে।
আরও পড়ুন>> রাইসির মৃত্যুর পেছনে ইসরায়েল জড়িত?
চলতি বছরের এপ্রিলে হিন্দি নিউজ চ্যানেল বোলতা হিন্দুস্তানকে গুগলের শর্তাবলী লঙ্ঘনের জন্য সম্প্রচার স্থগিত করা হয়। চ্যানেলের মালিকরা দাবি করেন, সরকারি নোটিশের প্রতিক্রিয়ায় তাদের সম্প্রচার স্থগিত করা হয়েছে। যদিও গুগল এ দাবি অস্বীকার করেছে।
একই মাসে আরেকটি নিউজ চ্যানেল ‘ন্যাশনাল দস্তক’ও একইরকম সমস্যার মুখোমুখি হয়। গুগলের একজন মুখপাত্র জানান, ন্যাশনাল দস্তক বোলতা হিন্দুস্তানকে পুনঃস্থাপন করেছে আর এর ‘মাত্র একটি ভিডিও’ ব্লক করা হয়েছে। কিন্তু কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা সবসময়ই চিন্তিত থাকেন সরকারি পদেক্ষেপ নিয়ে অথবা ইউটিউবের পরিষেবার শর্ত ভঙ্গ নিয়ে; যা তাদের চ্যানেল নিষিদ্ধ করতে পারে।
চলতি মাসের শুরুতে শ্যাম রঙ্গিলা নামের একজন কৌতুক অভিনেতা বারাণসীতে তার নির্বাচনী এলাকায় মোদির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দেন। কিন্তু তার প্রার্থিতা স্থগিত করা হয়। তবে এখনও তার কারণ জানানো হয়নি।
শ্যাম আইনি লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি তৃতীয় মেয়াদের দ্বারপ্রান্তে এসে মনে করতে পারেন, ভিন্নমত পোষণকারীদের আটকে রাখা তার ধারণার চেয়েও বেশি কঠিন।
আপন দেশ/এসএমএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।