জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ
দীর্ঘ ১৪ বছর পর মুক্ত জীবনে ফিরতে যাচ্ছেন উইকিলিক্সের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। গত ৫ বছর ধরে যুক্তরাজ্যের একটি কারাগারে বন্দি ছিলেন তিনি। এর আগের ৭ বছর যুক্তরাজ্যে অবস্থিত ইকুয়েডরের দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে অবস্থান করেছেন অ্যাসাঞ্জ। অবশেষে মার্কিন আদালতে দোষ স্বীকার করে একটি সমঝোতার পর ব্রিটেন থেকে তিনি মুক্তি পেলেন। তাকে মুক্তি দিতে অনেকদিন ধরে অনুরোধ করে আসছিল অ্যাসাঞ্জের দেশ অস্ট্রেলিয়া।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র গোপন নথি ফাঁসের অভিযোগ এনেছিল। দেশটি দাবি করেছে, অ্যাসাঞ্জ উইকিলিক্সে গোপন নথি ফাঁস করে মার্কিন সেনাদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছেন।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ কে এবং কী ফাঁস করেছিলেন
কিশোর বয়সেই কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের জন্য বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। তাকে ১৯৯৫ সালে হ্যাকিং করার অপরাধে জরিমানা করেছিল অস্ট্রেলিয়ার একটি আদালত। সে সময় আর কখনও এমনটা না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই কেবলমাত্র কারাদণ্ড এড়াতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে, উইকিলিক্স ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
আরও পড়ুন>> জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ কারামুক্ত
ওয়েবসাইটটির দাবি, যুদ্ধ, গুপ্তচরবৃত্তি ও দুর্নীতি সম্পর্কিত অনেক গোপনীয় সরকারি প্রতিবেদনসহ এক কোটিরও বেশি নথি প্রকাশ করেছে এটি। এরপর ২০১০ সালে একটি মার্কিন সামরিক হেলিকপ্টার থেকে করা একটি ভিডিও প্রকাশ করে উইকিলিক্স। যাতে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ১৮ জন বেসামরিক লোককে হত্যা করার দৃশ্য দেখা যায়।
ভিডিওতে একটি কণ্ঠ শোনা গেছে। সেই কণ্ঠকে বলতে শোনা গেছে, ‘সবাইকে জ্বালিয়ে দাও’। এরপরই বিভিন্ন ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়। এমনকি আহতদের উদ্ধারে আসা গাড়িকে লক্ষ্য করেও গুলি ছোড়া হয়েছিল। সেই হামলায় রয়টার্সের একজন আলোকচিত্রী ও তার সহকারী মারা গিয়েছিল।
এছাড়াও উইকিলিক্স মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রাক্তন গোয়েন্দা বিশ্লেষক চেলসি ম্যানিংয়ের সরবরাহ করা হাজার হাজার গোপনীয় নথি প্রকাশ করে। এসব নথিতে বলা হয়েছে যে, আফগানিস্তানে যুদ্ধের সময় মার্কিন সামরিক বাহিনী কয়েকশ বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে, যা রিপোর্ট করা হয়নি।
ইরাক যুদ্ধ সম্পর্কিত তথ্য ফাঁস করার পর তাতে দেখা গেছে, ৬৬ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক হত্যা করা হয়েছে। ইরাকি সেনারা বন্দিদের নির্যাতনের তথ্য ও মার্কিন কূটনীতিকদের আদান প্রদান করা আড়াই লাখ বার্তা ফাঁস করা হয়েছিল।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে টুইন টাওয়ারে হামলা হয়। এদিন একে অপরের খবর নিতে মানুষজন যেসব পেজার বার্তা প্রদান করেছিলেন, তার মধ্যে থেকে প্রায় ছয় লাখ বার্তা প্রকাশ করেছিলো উইকিলিক্স। ওই হামলার প্রতি সরকারি নানা দফতরের প্রতিক্রিয়াও ছিল।
সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বার্তাটি ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট সম্পর্কিত। তাতে লেখা ছিল, ‘প্রেসিডেন্টের যাত্রাপথ পরিবর্তন করা হয়েছে। তিনি ওয়াশিংটনে ফিরছেন না। তবে কোথায় যাবেন সে নিয়ে তিনি নিশ্চিত নন।’
২০১৫ সালে মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সনি পিকচারস-এর প্রায় দুই লাখ ইমেইল ও ২০ হাজার নথি ফাঁস করা হয়। সেসব ইমেইলে জানা যায়, এনজেলিনা জোলিসহ বিখ্যাত তারকাদের সম্পর্কে কোম্পানিটির প্রোডিউসার কেমন কটূক্তিমূলক কথাবার্তা বলেছেন। সেখানে উঠে আসে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে রাজি না হওয়ায় হলিউড তারকা লিওনার্ডো ডি ক্যাপ্রিওকে গালি দেয়া হয়েছে। আমেরিকান হাসল চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য অভিনেত্রী জেনিফার লরেন্স ও এমি অ্যাডামসকে পুরুষ অভিনেতাদের তুলনায় কত কম পারিশ্রমিক দেয়া হয়েছে।
২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের প্রচারণা বিষয়ক প্রধান জন পোডেস্টার ইমেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়। ফাঁস করা হয় কয়েক হাজার ইমেইল। তাতে ডেমোক্র্যাট পার্টি থেকে মনোনয়নের আগে দলের মধ্যে হিলারি ক্লিনটনের প্রতিদ্বন্দ্বী বার্নি স্যান্ডার্স সম্পর্কে কটূক্তি করা হয়েছিল।
নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের মধ্যে যে বিতর্ক টেলিভিশনে প্রচার করা হয়, তাতে সিএনএনের সাংবাদিক হিলারি ক্লিনটনকে একটি প্রশ্ন সম্পর্কে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। এ বিতর্কে প্রার্থীরা কেমন জবাব দিলেন তা ভোটের উপর প্রভাব ফেলে বলে মনে করা হয়।
উইকিলিকসের বিষয়ে মার্কিন সরকারের প্রতিক্রিয়া
২০১৯ সালে এ নথি ফাঁসের ঘটনাকে ‘যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আপসগুলোর মধ্যে একটি’ হিসেবে বর্ণনা করে মার্কিন বিচার বিভাগ। আইনজীবীরা বলেন, এসব তথ্য প্রকাশের ফলে আফগানিস্তান ও ইরাকের অনেক নামী ব্যক্তিকে ‘মারাত্মক ক্ষতি, নির্যাতন বা এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিতে’ ফেলেছে।
যদিও অ্যাসাঞ্জ জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, এসব নথি মার্কিন সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক গুরুতর অন্যায়ের তথ্য প্রকাশ করেছে। তার বিরুদ্ধে করা মামলা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তার বিরুদ্ধে সংবেদনশীল তথ্য সংগ্রহ করতে সামরিক বাহিনীর ডেটাবেজে প্রবেশ করার ষড়যন্ত্র করাসহ ১৮ অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
মার্কিন কর্তৃপক্ষ অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়া শুরু করে। তার আইনজীবীরা জানান, দোষী সাব্যস্ত হলে অ্যাসাঞ্জের ১৭৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বলছে, তার চার থেকে ছয় বছরের সাজা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
অ্যাসাঞ্জকে ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হওয়ার পর কয়েকদিন আগে তার সঙ্গে চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। এতে বলা হয়, অ্যাসাঞ্জ তার বিরুদ্ধে আনা একটি অভিযোগ স্বীকার করবেন এবং ক্ষমা চাইবেন। এর বদলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অভিযোগ তুলে নেবে। সেই সঙ্গে তাকে কোনো কারাদণ্ড দেবে না। কারণ তিনি ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যের কারাগারে পাঁচ বছর কাটিয়েছেন।
বিনিময়ে এতদিন ধরে কারাগারে থাকার বিষয়টি তার শাস্তি হিসাবে গণ্য হবে। তিনি মুক্ত ব্যক্তি হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যেতে পারবেন।
অবশেষে মুক্তির পর জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ অস্ট্রেলিয়া যেতে সোমবার (২৪ জুন) লন্ডনের একটি বিমানবন্দরে প্রাইভেট বিমানে উঠতে সক্ষম হন। বুধবার তার প্রাইভেট বিমানটি অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় অবতরণ করেছে। দীর্ঘ বছর পর পরিবারের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন তিনি।
আপন দেশ/এসএমএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।