Apan Desh | আপন দেশ

কেন আমি জুতো পরতে পারি না?

আপন দেশ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৮:০৫, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

কেন আমি জুতো পরতে পারি না?

নিজের মোবাইলে ছোট্ট হানানের স্বাভাবিক অবস্থার ছবি দেখাচ্ছেন শেফা। ছবি: আল-জাজিরা

ফিলিস্তিনির গাজায় ইসরায়েলি হামলায় দুই ছোট মেয়ে হারিয়েছে তাদের পা—হানান আল-দাক্কি। বয়স তিন। আর তার ছোট বোন মিসক। বয়স মাত্র দুই। দু'জনেই এখন হাসপাতালে। মৃত্যু ও আহতদের ভিড়ে কখনো নিজেদের পায়ের দিকে তাকিয়ে আবার কখনো তাদের অজানা ভবিষ্যতের দিকে।

‘মা কোথায়? আমার পা কোথায় গেল?’—বিছানায় শুয়ে থাকা হানান বারবার একই প্রশ্ন করছে তার ছোট বোন মিসককে। চোখে ভয়, মনের ভেতর অজস্র প্রশ্ন। আর কোন উত্তরই নেই। কারণ, তাদের মা, শাইমা আল-দাক্কি, একদিন সকালে পোলিও টিকা দিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর ইসরায়েলি বোমা হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন তিনি। আর শুধু তারা নয় পুরো পরিবার বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে।

শাইমার মৃত্যুর পর থেকে শেফা আল-দাক্কি, হানান ও মিসকের ফুপু, তাদের পাশে আছেন। তার নিজের কথা বলতে গেলে, শেফা জানেন না কীভাবে তাদের সান্ত্বনা দেবেন। তবুও প্রতিদিন চেষ্টা করেন তাদের একটু শান্ত রাখতে। যেহেতু এদের কষ্টের তো কোনো সীমা নেই। ছোট ছোট হৃদয়ের মধ্যে যে গভীর যন্ত্রণার সঞ্চার হয়েছে, তা হয়তো কখনো ভোলার নয়।

শেফা বলেন, বড় হয়ে তারা যখন বুঝবে, তখন কি আর তাদের সহ্য হবে? তারা যখন দেখবে, অন্য ছোটরা সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তারা কিছুই করতে পারছে না। তখন তাদের অনুভূতি কী হবে?

পূর্ব গাজার এল-বালাহে শাইমার পরিবার বাস করত। সেখানে বোমা হামলার পর শাইমা তার স্বামী মোহাম্মদ আল-দাক্কি ও দুই ছোট মেয়ে গুরুতর আহত হন। শাইমা মারা যান। কিন্তু হানান ও মিসককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সবকিছু করছিলেন শেফা।

হানানের শরীরের ক্ষত এত গভীর ছিল যে, তাকে দুই পা হারাতে হয়েছে। এক পা হাঁটুর উপরে এবং অন্য পা হাঁটুর নিচে কেটে ফেলতে হয়। মিসককেও তার বাঁ পা হারাতে হয়েছে। এ দুই বাচ্চার মধ্যে হানান সবচেয়ে বেশি অনুভব করে। মিসক হয়তো বুঝে না। কিন্তু হানান তাকে বারবার জিজ্ঞেস করে—‘কেন আমি পা হারালাম?’

হাসপাতালে খাবারের অভাব, চিকিৎসার অপ্রতুলতা, মানুষের ভিড়, আর অদৃশ্য নিরাপত্তার সংকট—সব মিলিয়ে শেফা যেন এক দুঃস্বপ্নে আটকে আছেন। ‘চার মাস ধরে আমরা যেন সেখানেই আটকা পড়েছি,’ তিনি বলেন।

তাদের অবস্থা এতই সঙ্কটময় যে, হাসপাতালেও তাদের মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা দেয়ার মতো সুযোগ নেই। তবে শেফা জানেন, তাদের চাচা আহমেদ তাদের খুব পছন্দ করে। কেননা আহমেদই একমাত্র ব্যক্তি যে তাদের হাসানোর চেষ্টা করে। হাসপাতালে যখন কিছু সময় থাকে তখন তাদের বাইরে নিয়ে যায়।

যতই দুঃখের মধ্যে দিন কাটাক না কেন, কিছু না কিছু তো তারা চায়। খেলনা, পোশাক, জুতো—তারা সবসময় কিছু চেয়ে থাকে। কিন্তু বাজারে তো কিছুই নেই। একে তো পণ্য-সামগ্রীর অভাব, তার উপরে গাজার আর্থিক অবস্থা। তবুও শেফা তাদের জন্য যা কিছু আনে। তাতে তারা খুশি থাকে। তবে ভেতরে সান্ত্বনাটুকু তাদের চিরকাল দেবে না—যে জায়গাটুকু শাইমা খালি রেখেছেন সেটি কখনো পূর্ণ হবে না।

শেফা বলেন, হানান ছোট ছিল। কিন্তু সাজতে খুব পছন্দ করত। সে সময় তার পছন্দের জামা আর জুতো ছিল। এখন সে আর জুতো পরতে পারে না। হানান একদিন বলল, কেন আমি জুতো পরতে পারি না? আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না।

শাইমা যখন তার মেয়েদের জন্য টিকা নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন ভাবেননি যে একদিন এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি আসবে। পোলিও থেকে সুরক্ষা পাওয়া, আর তারপর ইসরায়েলি হামলায় পা হারানো—কী অদ্ভুত পরিণতি!

হানান ও মিসকের চিকিৎসা এখনো শেষ হয়নি। ইসরায়েলি সীমানার কারণে তারা গাজা ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না। এ শিশুদের জন্য কৃত্রিম অঙ্গ প্রয়োজন। তবে তাও গাজায় সম্ভব নয়। তিন মাস ধরে তারা বাইরে যাওয়ার অনুমতির অপেক্ষায়। কিন্তু সে অনুমতি কখনো আসবে কি?

এ ছোট মেয়েদের জীবন আর কখনো আগের মতো হবে না, শেফা বলছেন। ‘হানান এখনো খুব ছোট, সে যখন বড় হবে, তখন সে জানবে—তার জীবন বদলে গেছে। সে জানবে, অন্যরা যেমন খেলতে যায়, সে তেমন কিছুই করতে পারবে না।

আজ তারা ছোট ছোট কথায় একে অপরকে সান্ত্বনা দেয়—‘মা জান্নাতে আছে’। কিন্তু একদিন তারা যখন বুঝবে তখন তাদের ভিতরে কী হবে?

আপন দেশ/এমবি

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়