
ফাইল ছবি
যতদূর চোখ গিয়েছে, চোখের সামনে যা কিছু পেয়েছে, ধ্বংস করা হয়েছে। যেখানেই কোনো ধরনের নড়াচড়া চোখে পড়েছে, গুলি করে তা স্তিমিত করে দেয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনিরা যেন আর কোনোদিনই এখানে ফিরতে না পারেন, সে ব্যবস্থাই করেছে সেনারা।
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সেনাদের চালানো গণহত্যার বিবরণ এটি। পরিচয় গোপন করে নিজেদের অপরাধের এ স্বীকারক্তি দিয়েছে কয়েকজন ইসরায়েলি সেনা। শুধু তাই নয়; বাফার জোনকে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করার “কিলিং জোনে” পরিণত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের ট্যাঙ্ক স্কোয়াডে থাকা এক সেনা কর্মকর্তা।
ট্যাঙ্কগুলোর ৫০০ মিটারের মধ্যে কেউ এলেই তাকে গুলি করা হত, হোক সে নারী বা শিশু! হতভাগ্য ফিলিস্তিনিরা জানেনও না ঠিক কোন পর্যন্ত এই বাফার জোনের বিস্তৃতি। না জেনেই হয়তো প্রবেশ করে ফেলেন মরণ ফাঁদে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সেনা বলেন, ২০২৩ সালের অক্টোবরে তারা (হামাস যোদ্ধারা) আমাদের মেরেছে, তাই আমরা তাদের মারতে এসেছি। কিন্তু এখানে এসে দেখছি, আমরা শুধু তাদের নয়, তাদের স্ত্রী, সন্তান, কুকুর, বিড়াল সব কিছুই মারছি।
ওই সেনাদের অনেকেই ৭ অক্টোবরের হামলার প্রতিশোধ নিতে এভাবে বেসামরিক মানুষগুলো মেরেছে বলেও কাঁপা গলায় স্বীকার করেছেন ওই সেনা।
স্থানীয় সময় সোমবার ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের এক প্রতিবেদনে বাফার জোনে থাকা কয়েকজন সেনার স্বীকারোক্তি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দখলবিরোধী এ ভেটেরান্স গ্রুপের প্রতিবেদনে জানা গেছে, গাজার ভূমি দখল করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই গাজাকে এভাবে ধ্বংস করেছে ইসরায়েল প্রশাসন।
ওই সেনাদের মধ্যে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসোসিয়েট প্রেসকে (এপি) সাক্ষাৎকার দেন ৫ জন। এপির খবরে সেনাদের বয়ানে দখলদার ইসরায়েলের ভয়াবহতার এক অসহনীয় চিত্র উঠে আসে। তারা জানান, ২০২৩ সালে হামাসের হামলার পর নিজ দেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই তারা এখানে যুদ্ধ করতে এসেছেন।
অবিরাম বোমাবর্ষণ আর স্থল অভিযানে গাজার প্রায় সবগুলো শহর ও নগর ধ্বংস করা হলেও বাফার জোনের ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা সবকিছুকে হার মানিয়েছে।
যুদ্ধের প্রথমদিকে সীমান্তের নিকটবর্তী গাজার এক কিলোমিটারের বেশি এলাকায় বাস করা ফিলিস্তিনিদের জোর করে সরিয়ে একটি বাফার জোন তৈরি করে ইসরায়েলি সেনারা। এজন্য সেখানে থাকা সব স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে তারা।
ইসরায়েলি সৈন্যরা “নেতজারিম করিডোর” নামে পরিচিত গাজার একটি বিশাল ভূমিও দখল করেছে। এ করিডোরটি গাজা সিটিসহ উত্তরাঞ্চলকে সংকীর্ণ ও উপকূলীয় উপত্যকাটির বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
এপির খবরে ওই পাঁচ সেনা জানান, বাফার জোনের ফসলের মাঠ, সেচের পাইপ, শস্য, গাছপালা, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাগুলো ধ্বংসের জন্য ইসরায়েল প্রশাসন থেকে বিশেষ নির্দেশ পেয়েছিলেন তারা। যাতে সেখানে হামাসের কোনো যোদ্ধা লুকিয়ে থাকার সুযোগ না পান। সেনারা জানান, তারা এত পরিমাণ স্থাপনা ধ্বংস করেছে, তা গুনেও বলতে পারবেন না।
ইসরায়েলি সেনারা গাজার যে অংশে বাফার জোন তৈরি করেছে, সেটি এক সময় লাখ লাখ ফিলিস্তিনির পদচারণায় মুখরিত ছিল। গাজার কৃষিকাজের জন্য এ ভূমি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেখা যায়, ওই এলাকাগুলোর কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বাফার জোন। যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে গত ১৮ মার্চ নতুন করে গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করলে বাফার জোনে অতিরিক্ত আরও সেনা মোতায়ন করে ইসরায়েল।
এর আগে গত ১৯ জানুয়ারি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে বাফার জোনের নিজ বসতবাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন ৫৫ বছর বয়সী কৃষক নিদাল আলজানিন। তবে তার বসতভিটা আগেই ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েলি সেনারা।
বাড়ি বলতে সে অর্থে আর কিছুই ফিরে পাননি নিদাল, পেয়েছেন কেবল স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহের সময়কার একটি ছবি, পোর্সেলিনের প্লেটে আঁকা তার ছেলের মুখখানা আর ১৫০ বছরের পুরনো একটি ডুমুর গাছ।
নাদিল বলেন, এ বাড়িটি বানাতে আমার ২০ বছর সময় লেগেছিল। অথচ মাত্র ৫ মিনিটে তারা এটি শেষ করে দিয়েছে। তারা শুধু আমার বাড়িই নয়, আমার স্বপ্ন, আমার সন্তানদের স্বপ্নও শেষ করে দিয়েছে।
এ আর্তনাদ কেবল নাদিলের একার নয়, গাজা উপত্যকার প্রতিটি মানুষের। স্বজন, সম্পদ, আশ্রয় সব হারিয়ে নিঃস্ব গাজাবাসী। যুদ্ধবিরতির পর নিজ বাড়ির ধ্বংসস্তূপের ওপরই তাঁবু টানিয়ে থাকতে শুরু করেছিলেন নাদিলের মতো অনেক ফিলিস্তিনি।
কিন্তু অভাগাদের কপালে তাও সইলো না। যুদ্ধবিরতি নিয়ে নানা টালবাহানার মধ্যেই ১৮ মার্চ ভোররাতে সেহেরির সময় অসহায় গাজাবাসীর ওপর পূর্ণমাত্রায় অভিযান চালানোর আদেশ দেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। আবার প্রাণভয়ে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা।
নতুন করে চালানো এসব হামলায় অন্তত ১,৩৩৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও ৩,২৯৭ জন আহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে হামাস শাসিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এদিকে, ২০২৩ সালের পর থেকে ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫০,৬৯৫ জন ফিলিস্তিনি, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। আর পোলিও টিকার অভাবে গাজার ৬ লাখ ২ হাজার শিশু স্থায়ীভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে।
আপন দেশ/জেডআই
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।