ফাইল ছবি
আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিরোধ কমছে। মধ্যপ্রাচ্যে মৈত্রী ও শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। সৌদি আরব-ইরান, কাতার-বাহরাইন, সৌদি আরব-ইয়েমেন সম্পর্ক স্বাভাবিক হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছে আরব বিশ্বের অনেক দেশ। ফলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির ভাব আসবে; এর সুফলও মিলবে বলে মত আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, মুসলিমরা আরো বেশি সংগঠিত হবে এসব দেশের বিরোধ মিটে যাওয়ায়।
খবরে জানা যায়, দীর্ঘ এক যুগ পর রাষ্ট্রীয় সফরে সৌদি আরবে গেছেন সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল মেকদাদ। তার এই সফরের মধ্য দিয়ে সিরিয়ার দীর্ঘদিনের আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা অবসানেরই সংকেত পাওয়া যাচ্ছে।
দীর্ঘ সময় বিরোধে ছিল আরব বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী বৃহৎ দুটি দেশ সৌদি আরব ও ইরান। তাদের মধ্যে সম্পর্ক পুনপ্রতিষ্ঠা হচ্ছে। সৌদি আরবে ইরানের দূতাবাসের দরজা সাত বছরের মধ্যে প্রথমবার খোলা হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক জানিয়েছেন, বুধবার রিয়াদে ইরানি দূতাবাস প্রাঙ্গণের ভারী গেটটি খোলা ছিল এবং একটি দল সেটি পরিদর্শন করছিলো। এ সময় একটি সাদা ট্রাককে গেটের কাছে উপস্থিত হতে দেখা যায়।
সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় হওয়া এক চুক্তির আওতায় সৌদি আরব ও ইরান কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারো স্বাভাবিক করার পর্যায়ে আছে। এই দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা শক্রতা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন সংঘাতে পরস্পরবিরোধী পক্ষগুলোকে ইন্ধন যুগিয়েছে।
এদিকে কাতার ও বাহরাইনের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোড়া লাগতে যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের বিরোধের সুরাহা করতে যাচ্ছে দেশ দুটি। দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পৃথক বিবৃতি দিয়ে এ তথ্য জানায়।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, উভয়পক্ষ জিসিসি সনদ অনুযায়ী, উপসাগরীয় ঐক্য-সংহতি বাড়াতে বৈঠক করেছে।
বুধবার দেশ দুটির প্রতিনিধিরা সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) সদর দফতরে বৈঠক করেন।
২০১৭ সালে সৌদি আরবের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসর। তারা দাবি করেছিল, ইরানের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখছে কাতার। তাই তারা কাতারের ওপর কূটনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিলো।
বলা চলে, ২০১১ সালের পর এই প্রথম সিরিয়ার কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদি আরব সফরে গেলেন। ওই বছর সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। দেশটিকে বয়কট করে পশ্চিমারাসহ বহু আরব দেশও। সৌদি আরব তখন সিরিয়ার বিদ্রোহীপক্ষকে সমর্থন করেছিল। দেশের অভ্যন্তরে বিক্ষোভ দমনে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের চরম কঠোর অবস্থানের জেরে ২০১১ সালে সিরিয়াকে আরব লিগ থেকেও বরখাস্ত করা হয়।
এখনো অনেক পশ্চিমা এবং আরব দেশ সিরিয়াকে বয়কট করে রেখেছে। তবে সম্প্রতি সৌদি আরব সিরিয়াকে কাছে টেনে নেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। আগামী ১৯ মে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে আরব লিগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। তাতে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা করছে সৌদি আরব সরকার।
রিয়াদ এবং দামেস্কের মধ্যে আবারো সম্পর্ক স্থাপন করা এবং একে অপরের দেশে দূতাবাস চালু নিয়ে সমঝোতাও হয়েছে। এর প্রেক্ষাপটেই সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদি আরব সফর করছেন।
সৌদি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিরিয়া সংকটের একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা নিয়ে আলোচনা করবেন। যা সিরিয়ার ঐক্য, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা রক্ষায় কাজ করবে। তা ছাড়া, বৈঠকে সিরীয় শরণার্থীদের দেশে ফেরানো এবং সিরিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মানবিক ত্রাণ প্রবেশের পথ সুগম করা নিয়েও আলোচনা হবে।
সিরিয়াকে আরব লিগে ফেরানো নিয়ে আঞ্চলিক আরব দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আরেকটি বৈঠক করার কথা রয়েছে সৌদি আরবের। এই বৈঠকের দু’দিন আগে সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেকদাদ সৌদি আরব সফরে গেলেন।
ইরাক, জর্ডান, মিশর এবং উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি) দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা শুক্রবার জেদ্দায় সমবেত হবেন জানিয়েছে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। জিসিসি’র দেশগুলো হচ্ছে- সৌদি আরব, ইউএই, বাহরাইন, ওমান, কাতার এবং কুয়েত।
এদিকে রিয়াদে ইরানের দূতাবাস খোলার বিষয়ে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ইরানের একটি প্রতিনিধি দল সৌদি আরবে পৌঁছেছে। এর কয়েক ঘণ্টা পর দেশটির কূটনৈতিক মিশনটির গেট খোলা হয়।
এক বিবৃতিতে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি বলেন, রিয়াদ ও জেদ্দায় দূতাবাস ও কনস্যুলেট চালু করার জন্য ইরানের প্রতিনিধি দলটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
সৌদি আরব সুপরিচিত এক শিয়া ধর্মীয় নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর ক্ষুব্ধ হয় শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরান। এর জেরে দেশটির বিক্ষোভকারীরা তেহরানের সৌদি দূতাবাসে হামলা চালালে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে রিয়াদ এবং ইরানি কূটনীতিকদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেয়, পাশাপাশি তারা তেহরান থেকে নিজেদের দূতাবাস কর্মীদের সরিয়ে নিয়ে আসে। এরপর থেকে রিয়াদের ইরানি কূটনৈতিক মিশনটি বন্ধ ছিল। গত মাসে চীনের উদ্যোগে হওয়া ওই চুক্তিতে তেহরান ও রিয়াদ কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের সমাপ্তি টেনে ফের কূটনৈতিক মিশন চালু করতে সম্মত হয়।
চলতি মাসের প্রথমদিকে উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বেইজিং এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন, যা তাদের দুই দেশের শীর্ষ কূটনীতিকদের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক।
শনিবার সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তেহরান ও মাশহাদ শহরে রিয়াদের দূতাবাস ও কনস্যুলেট ফের চালু করার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতে সৌদি কর্মকর্তারাও ইরানে আছেন।
ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধেও পদক্ষেপ আসার সম্ভাবনা দেখা গেছে। এ বিষয়ে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে আলোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। মঙ্গলবার মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমিয়ে আনার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন তারা। সৌদির এই শান্তি প্রচেষ্টায় সমর্থনের কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এদিকে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সৌদি-ইরান চুক্তির ক্ষেত্রে বেইজিং যে ভূমিকা রেখেছে, তাতে সৌদি আরবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমে গেছে। সৌদির তেল উৎপাদন কমিয়ে দেয়া, মানবাধিকারসহ নানা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
অনেকে মনে করছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বদলে যাচ্ছে বিশ্বের চালচিত্র। আর এই পবির্তনের খুশি পাকিস্তান, বেজায় নাখোশ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র। কারণ আমেরিকার প্রতিপক্ষ চীনের বলয়ে প্রবেশ করে মধ্যপ্রাচ্য। এই কারণ ইরান-সৌদি আরব, আমিরাত ভারত ও আমেরিকার মুখিতা ছেড়ে চীন-রাশিয়া পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছে।
মধ্যপ্রাচ্যে গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নাটকীয় এক ঘটনা ঘটে গেছে। সাত বছর আগে ভেঙে পড়া সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছে অঞ্চলের সবচেয়ে দুই প্রভাবশালী বৈরী দেশ সৌদি আরব ও ইরান।
বিস্ময়কর যেটি তা হলো এই সম্পর্ক জুড়তে মধ্যস্থতা করেছে সৌদি আরবের দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরঞ্চ বর্তমানে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর প্রতিপক্ষ-চীন।
মার্চের ১০ তারিখে বেইজিংয়ে সৌদি ও ইরানের কর্মকর্তাদের পাশে নিয়ে শীর্ষ চীনা কূটনীতিক ওয়াং ই এই বোঝাপড়ার কথা ঘোষণা করেন। তারপর, দ্রুতগতিতে ঘটনা গড়াচ্ছে।
এদিকে ওমানের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইয়েমেনে হুতিদের মধ্যে গত রোববার ইয়েমেনের রাজধানী সানায় বৈঠক হয়েছে। দেশটিতে দীর্ঘদিনের যুদ্ধ থামাতে হুতিদের সঙ্গে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করেছে রিয়াদ। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে দীর্ঘদিনের ছায়াযুদ্ধ হিসেবে দেখা হয় একে। হুতিদের সমর্থন দিয়ে আসছে ইরান। ২০১৪ সালে সৌদি-সমর্থিত সরকারকে হটিয়ে সানার ক্ষমতা দখল করে হুতিরা। এরপর থেকে সৌদি সামরিক জোটের সঙ্গে তাদের লড়াই শুরু হয়।
ইয়েমেন ও সৌদি আরবের চুক্তির পর দুই দেশের বন্দী বিনিময় প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। ইয়েমেনের এক সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, বৃহস্পতিবার বন্দী বিনিময় শুরু হয়। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে শান্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ইয়েমেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে হাজারো মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণে মারা গেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে মানবিক সমস্যায় পড়েছে দেশটি। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসের পর থেকে এটিই সবচেয়ে বড় বন্দী বিনিময়ের ঘটনা। ইয়েমেনের সরকারি মুখপাত্র মাজিদ ফাদায়েল বলেন, তিন দিন ধরে চলবে বন্দী বিনিময়। ইয়েমেন ও সৌদি আরবের কয়েকটি শহরে বন্দী বিনিময় ঘটবে। দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৯০০ বন্দী বিনিময় হবে। এর মধ্যে বেশির ভাগই হুতি বিদ্রোহী।
সৌদি আরব ও ইয়েমেনের সরকারি বাহিনীর হাতে আটক ৭০৬ বন্দীর বিনিময়ে হুতিরা ১৮১ বন্দীকে মুক্তি দেবে। তাদের অধিকাংশই সৌদি ও সুদানি নাগরিক। ফাদায়েল বলেন, বন্দী বিনিময়ের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। নিরাপদে বন্দী স্থানান্তর প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংস্থা রেডক্রস বা রেডক্রিসেন্ট।
আপন দেশ/আরএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।