ছবি : সংগৃহীত
উপজাতি দুই নারীকে জনসমক্ষে নগ্ন করে ঘোরানোর পর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশটিতে। বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) রাজ্যের চুরাচাঁদপুর এলাকায় হাজারো মানুষ অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন।
এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দেশটির সুপ্রিম কোর্টও এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আদালত খুবই মর্মাহত হয়ে সরকারকে এ ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেন। এ ঘটনার একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনিই মূল পরিকল্পনাকারি বলে ধারণা করা হচ্ছে। মণিপুরের একটি আদালতে ধর্ষণ-নিগ্রহের শিকার এক নারী বৃহস্পতিবার জবানবন্দি দিয়েছেন।
ওই দুই নারীকে নিপীড়নের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পর ক্ষোভে ফেটে পড়েন হাজারো মানুষ। গত ৪ মে ভিডিওটি প্রথম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এর আগের দিন স্থানীয় হিন্দু মেইতি ও খ্রিস্টান কুকি সম্প্রদায়ের মাঝে জাতিগত দাঙ্গা দেখা দেয়।
ভিডিওতে দেখা যায়, দুই নারীকে নগ্ন করে রাস্তায় ঘোরানোর পর একটি মাঠে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরে একদল জনতা তাদের ওপর সংঘবদ্ধ যৌন নিপীড়ন চালায়। ভিডিওটি নতুন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় লোকজনের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এ ঘটনায় অজ্ঞাত সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ ও অপহরনের মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। মণিপুরের এই ঘটনা ভারতকে লজ্জিত করেছে মন্তব্য করে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, দোষীদের কাউকে ছাড়া হবে না।
আরও পড়ুন <<>> দলবদ্ধ ধর্ষণের পর নগ্ন করে দুই নারীকে রাস্তায় হাঁটিয়ে ভিডিও ধারণ
‘আইন যে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে, সে বিষয়ে আমি দেশকে আশ্বস্ত করতে চাই। মণিপুরের কন্যাদের সঙ্গে যা হয়েছে, তা ভুলে যাওয়া হবে না,’ উত্তরপূর্বের রাজ্যটিতে সহিংসতা শুরু হওয়ার দুই মাসেরও বেশি সময় পর মণিপুর নিয়ে নীরবতা ভেঙে এমনটিই বলেছেন মোদি।
এ ঘটনাকে সভ্যসমাজের জন্য কলঙ্কজনক উল্লেখ করে বৃহস্পতিবার ভারতের পার্লামেন্ট লোকসভার বর্ষাকালীন অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার হৃদয় আজ ক্রোধে, যন্ত্রণায় ভারাক্রান্ত। মণিপুরের যে ঘটনাটি আমাদের সামনে এসেছে- যে কোনো সভ্য সমাজের জন্য তা লজ্জাকর, কলঙ্ক। মণিপুরের মেয়েদের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে আইন তার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে।’
ভারতের সুপ্রিম কোর্টও এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় বলেছেন, দুই নারীকে নগ্ন করে হাঁটানোর ভিডিও নিয়ে আদালত খুবই মর্মাহত; তিনি সরকারকে এ ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতেও বলেন।
এদিন মণিপুর পুলিশ ২৬ সেকেন্ডের ফুটেজ দেখে প্রাথমিক সন্দেহভাজনদের একজনকে আটক করেছে। থৌবাল জেলা থেকে তাকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। স্থানীয় কর্মকর্তাদের ধারণা, আটককৃত ব্যক্তিকেই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী।
ভিডিওটি প্রকাশের পর মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং জনসাধারণকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, জঘন্য এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব অপরাধীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের চিন্তাভাবনাসহ কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঘটনার তদন্ত এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের একাধিক তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে।
এক টুইটে তিনি বলেন, ওই দুই নারীর জন্য আমার হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে; যারা অত্যন্ত অসম্মান ও অমানবিক কাজের শিকার হয়েছেন। এই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত চলছে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিতে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। দলটির প্রেসিডেন্ট মালিকঅর্জুন খার্গে এক টুইট বার্তায় ক্ষমতাসীন বিজেপির তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মণিপুরে মনুষত্ব মরে গেছে। মোদি আর বিজেপি সরকার সেখানে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনকে উশৃঙ্খলশাসনে পরিণত করেছে, রাজ্যের সামাজিক কাঠামো ধ্বংস করেছে। যদি কোনো লজ্জা থাকে, মণিপুরে কী হয়েছে সেটি নিয়ে পার্লামেন্টে কথা বলবেন।’
ভারতীয় অভিনেতা অক্ষয় কুমারও এ নিয়ে একটি টুইট করেছেন। তিনি এতে লিখেছেন, ‘মণিপুরে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা দেখে আমি কম্পিত, বিরক্ত। এর সঙ্গে জড়িতদের এমন শাস্তি দেয়া হোক যা দেখে কেউ ভবিষ্যতে এমন কিছু করার চিন্তাও যেন না করে।’
দুই নারীর ওপর এই আক্রমণের ঘটনাটি গত ৪ মে ঘটেছে বলে পুলিশও জানিয়েছে। সম্প্রতি ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হতে শুরু হলে বৃহস্পতিবার তা ভারতের জাতীয় দৈনিকগুলোর শিরোনামে জায়গা করে নেয়।
আরও পড়ুন<<>> বিশ্বজুড়ে বাড়ছে গম-ভুট্টার দাম
মণিপুরে মে মাস থেকে শুরু হওয়া জাতিগত সহিংসতা এরই মধ্যে অন্তত ১৩০ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, হাজারো বাসিন্দাকে করেছে বাস্তুচ্যুত। রাজ্যটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেই জাতিগোষ্ঠীর সদস্য সেই মেইতিরা আদিবাসী মর্যাদা চাওয়ার পর থেকেই তাদের সঙ্গে কুকি সম্প্রদায়ের সদস্যদের সংঘর্ষ বাধে। আদিবাসী মর্যাদা পেলে মেইতিরা বনভূমি ও সরকারি চাকরিতে নানান সুযোগ সুবিধা, শিক্ষায় কোটা সুবিধা পাবে। দুই পক্ষের সংঘর্ষ এরই মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার মানুষকে নিজভূমে শরণার্থী বানিয়ে দিয়েছে।
সহিংসতায় আক্রান্ত রাজ্যটিতে সফর না করায়, কিংবা সহিংসতা নিয়ে এখন পর্যন্ত কিছু না বলায় বিরোধীরা অনেকদিন ধরেই প্রধানমন্ত্রী মোদির সমালোচনা করে আসছেন।
ভিডিওতে একদল উন্মত্ত লোককে ওই দুই নারীকে টেনে হিঁচড়ে একটি মাঠের দিকে ঠেলে দিতে দেখা যায়। পরে জানা গেছে, সেই মাঠে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ওই দুই নারী।
ইন্ডিজেনাস ট্রাইবাল লিডালস ফোরাম (আইটিএলএফ) এক বিবৃতিতে বলেছে, কাংপোকপি জেলার একটি গ্রামে কুকি সম্প্রদায়ের ওই দুই নারীর সঙ্গে এ বর্বরতা হয়েছে। দুই নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলেও অভিযোগ তাদের।
জানা যায়, সংশ্লিষ্টরা ভুয়া খবরে উত্তেজিত হয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। প্রাথমিক তদন্তে এ তথ্য মিলেছে বলে মণিপুর পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা দেশটির সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে জানিয়েছেন।
তারা বলেছেন, জনজাতি অধ্যুষিত মণিপুরে সহিংসতার শিকার ওই দুই নারী এবং তাদের ওপর হামলাকারীরা পরস্পর ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর। গত ৩ মে মণিপুরে দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর হামলা থেকে বাঁচতে তারা রাজধানী থেকে দূরের থৌবল জেলার নংপোক সেংমাই থানার একটি গ্রামে আশ্রয় নেন। থানা থেকে ওই গ্রামটির দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার।
কর্মকর্তারা জানান, ঘটনার আগের দিন ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, ওই নারীরা যে জনগোষ্ঠীর- সেই গোষ্ঠীর কয়েকজন পুরুষ হামলাকারীদের জনগোষ্ঠীর একাধিক নারীকে ধর্ষণ করেছেন, যা ছিল আসলে গুজব বা ভুয়া সংবাদ। তার প্রতিশোধ নিতেই ওই নারীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল দুষ্কৃতিকারীরা।
হামলার শিকার আদিবাসী সেই দলটিতে সদস্য ছিলেন মোট পাঁচ জন। তারা হলেন, ৫৬ ও ১৯ বছর বয়সী দুই পুরুষ এবং তিন জন নারী। যাদের বয়স যথাক্রমে ২১, ৪২ এবং ৫২ বছর। এই পাঁচ জনের মধ্যে দুই পুরুষ ও ২১ বছরের ওই নারী এক পরিবারের সদস্য। ওই তরুণী এবং ১৯ বছরের সেই তরুণ সম্পর্কে ভাইবোন এবং ৫৬ বছর বয়সী পুরুষটি ছিলেন তাদের বাবা।
যে গ্রামে তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন, পরের দিন ৪ মে সেখানে দুষ্কৃতিকারীরা হামলা চালায় এবং নির্বিচারে হত্যা-লুটপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। এ সময় তাদের অনেকের হাতেই একে-৪৭, ইনসাস ও এএলআরসহ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ছিল। হামলা থেকে বাঁচতে ওই পাঁচজন গ্রামের পাশের একটি জঙ্গলে আশ্রয় নেন। পরে নংপোক সেংমাই থানার পুলিশ সদস্যদের একটি দল উদ্ধার করে থানার পথে রওনা হন।
কিন্তু মাঝপথে হামলাকারীদের একটি দল পুলিশের গাড়ি ঘিরে ফেলে এবং গতিরোধ করে ওই পাঁচজনকে ছিনিয়ে নেয়। প্রথমেই ৫৬ বছর বয়সী ব্যক্তিকে হত্যা করে, তারপর তারা নারীদের বিবস্ত্র অবস্থায় হাঁটতে বাধ্য করে। এ সময় বোনকে বাঁচাতে ১৯ বছরের তরুণটি এগিয়ে এলে তাকেও হত্যা করে দুষ্কৃতিকারীরা। নারীদের হাঁটিয়ে একটি মাঠের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
যে মাঠে ঘটনাটি ঘটেছিল, নংপোক সেংমাই থানা থেকে তার দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার। দুষ্কৃতিকারীরা চলে যাওয়ার পর কঙ্গলকপি জেলার সাইকুল থানায় ‘জিরো এফআইআর’ দায়ের করেন ওই তরুণী।
তবে মণিপুর পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে- ‘জিরো এফআইআর’ করার পরও গত আড়াই মাসে অপরাধীদের ধরতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। তাদের তৎপরতা শুরু হয়েছে সামাজিকমাধ্যমে সেই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর।
আপন দেশ/আরএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।