ফাইল ছবি
জাতীয় অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে শুনানি হয়। শুনানি শেষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীরা ক্ষমতায় থাকতে গোটা জাতির ওপর হত্যাকাণ্ড চালাতে দ্বিধা করেননি। তাদের শুধু এক ব্যক্তিকে (শেখ হাসিনা) ক্ষমতায় রাখতে তারা গণহত্যা চালিয়েছেন। এমনকি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য গোটা জাতিকেও হত্যা করতে তারা দ্বিধা করতেন না।
সোমবার (১৮ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে তিনি এ কথা বলেন।অপর দুই বিচারপতি হলেন– বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এদিন সকাল ১০টার দিকে একাধিক প্রিজন ভ্যানে করে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, ফারুক খান, শাহজাহান খান, কামাল আহমেদ মজুমদার, গোলাম দস্তগীর গাজী, ডা. দীপু মনি, জুনাইদ আহমেদ পলক, সালমান এফ রহমান, ড. তৌফিক-ই-ইলাহী, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলমকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। আব্দুর রাজ্জাককে হাজির করার নির্দেশ থাকলেও টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার এক মামলায় রিমান্ডে থাকায় তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়নি। সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে হাজতখানা থেকে তাদের এজলাসে রাখা ডকে তোলা হয়। তবে নারী বিবেচনায় ডা. দীপু মনিকে ডকে না তুলে এজলাস কক্ষের পাশে চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়। বেলা ১১টার দিকে বিচারপতিরা আসন গ্রহণ করেন। তারপর শুনানি শুরু হয়। কিছুক্ষণ সব আসামি এজলাস কক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর আদালত সবাইকে বসতে অনুমতি দেন।
শুনানি শুরু হলে প্রথমেই চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, আজ আসামিপক্ষে সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজী শুনানি করতে এসেছেন। তবে তিনি রাষ্ট্রীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতে যাচ্ছেন বলে জানতে পেরেছি। ২/১ দিনের মধ্যেই হয়ত সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করবে। তাই তিনি আসামিপক্ষে শুনানি করলে এটা হবে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। এসময় তাজুল ইসলাম তাকে আসামিপক্ষে শুনানি না করতে অনুরোধ জানান।
এরপর এহসানুল হক সমাজী আদালতকে বলেন, আমি এখনো ফরমাল কোনো লেটার পাইনি। ফরমাল লেটার পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। এছাড়া যে পদ আমাকে দেওয়া হবে সেটি আমি গ্রহণ করি কি না তাও ভাববার বিষয়।
এসময় বিচারক জানতে চান কোন আসামির পক্ষে তিনি এসেছেন। উত্তরে সমাজী পাঁচ আসামির নাম বলেন। তারা হলেন– সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক, তৌফিক-ই-এলাহী, ফারুক খান ও জুনায়েদ আহমেদ পলক। এসময় তিনি শুনানি না করে আরেক আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলুকে দায়িত্ব দেন।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম শুনানিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে শুনানি করেন। তিনি শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের বিভিন্ন অপরাধের তথ্য বিশদভাবে তুলে ধরেন। যাকে তিনি ফ্যাসিবাদের দুঃশাসন হিসেবে অভিহিত করেন। এর মধ্যে গুম, খুন, সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ, বিচার বিভাগকে ব্যবহারসহ নানা বিষয় ছিল। এরপর গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের তথ্য তুলে ধরেন। কীভাবে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, গুলি চালানো হয়, গণহত্যা চালানো হয় তা উল্লেখ করেন।
তাজুল ইসলাম বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে উৎখাতের পথ সুগম ছিল না। দেড় হাজার মানুষের প্রাণ, ২৫ হাজার আহতের মাধ্যমে সর্বগ্রাসী শাসন থেকে ন্যায়পরায়ণ দেশ পেয়েছি। জেন-জির চূড়ান্ত আত্মত্যাগে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর থেকে শুরু হয় স্বৈরাচারী আচরণ। বিরোধীদের দমন, গুম, খুন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া, ভিন্নমত পোষণকারীদের নিপীড়ন করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হয়। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার গঠন করে। ২০১৮ সালে বিএনপি অংশ নিলে কারচুপি, দিনের ভোট রাতে করে। ২০২৪ সালে আমি আর ডামি নীতি অনুসরণ করে নির্বাচন করে জোর করে ক্ষমতায় বসেন। ফ্যাসিবাদের ১৫ বছরে হাসিনার নেতৃত্বে হত্যা, গুম, হেফাজতে ইসলামের ওপর হত্যাকাণ্ড, পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটে। প্রহসনের বিচার চলত। আয়নাঘর সৃষ্টি করে। গত ১৫ বছরে ৬১১ জনকে গুম করা হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি, অর্থপাচারের ঘটনা ঘটে। দুই লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। শেয়ারবাজার থেকে লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। রাজাকার শব্দ ব্যবহার করে জাতিকে বিভক্ত করা হতো। মানুষ একটা সুযোগ খুঁজছিল। কোটা আন্দোলন পরে গণআন্দোলনে রূপ নেয়।
এরপর আদালত জানতে চান, শেখ হাসিনার ওয়ারেন্টের কী হলো? তাজুল ইসলাম বলেন, তিনি পালিয়ে গেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানতে পেরেছে, তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। বন্দি বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে সরকার তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
এসময় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা তদন্তে দুই মাস সময় চায় তদন্ত সংস্থা। পরে আদালত এক মাস সময় মঞ্জুর করেন। আগামী ১৭ ডিসেম্বর প্রতিবেদন জমা দিতে বলেন। এসময়ের মধ্যে ওয়ারেন্ট কার্যকর করতে নির্দেশ দেন।
এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের অভিযোগের বিষয়ে শুনানি হয়। তাজুল ইসলাম বলেন, এ মামলায় ১৪ জন গ্রেফতার আছেন। এদের মধ্যে ১৩ জনকে হাজিরা করা হয়েছে। আব্দুর রাজ্জাককে হাজির করা হয়নি। তার বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ। দেশব্যাপী কোটা আন্দোলন শুরু হয়। বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়। সংস্কারের জোর দাবি জানানো হয়। হাসিনা ১৪ জুলাই আন্দোলন প্রতিহত করতে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, দীপু মনি, আ ক ম মোজাম্মেল হক, সজিব ওয়াজেদ জয় উসকানিমূলক বক্তব্য দেন ও আন্দোলন দমনে গণহত্যার নির্দেশ দেন।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, হাসিনার পরিবারের সদস্যরা ১৬ বছরে দুর্নীতি, টাকা পাচার করে এবং অন্যদেরও সুযোগ করে দেয়। হাসিনার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন শেখ রেহানা, সজিব ওয়াদেদ জয়, ববি, শেখ সেলিম, হাসানাত আব্দুল্লাহ, সাদিক আব্দুল্লাহ, শেখ হেলাল, সারহান নাসের তন্ময়, মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী। পাশাপাশি দেশব্যাপী হত্যাযজ্ঞ চালাতে তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। ডিবির হারুন, বিপ্লব, প্রলয় কুমার জোর্য়াদার, হাবিবুর রহমান, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, তারেক সিদ্দিকীর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ও পরিকল্পনায় দিনের পর দিন হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকে। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, জাফর ইকবাল, নিঝুম মজুমদারও আন্দোলনের সময় উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। অভিযোগ আসা কয়েকজনের নাম বলতে চাননি প্রসিকিউটর।
তাজুল ইসলাম বলেন, আন্দোলন ঢাকা থেকে শুরু হয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। রংপুরে আবু সাঈদ প্রথম নিহত হয়। একই দিনে আরও পাঁচ জনকে হত্যা করা হয়। ৫ আগস্ট লং মার্চের ডাক আসে।। ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা পালিয়ে যান। তারপরও তার নেতাকর্মীরা ওইদিন গভীর রাত পর্যন্ত গণহত্যা চালায়। ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত এই ১৩ আসামিসহ অন্যরা তিন বাহিনীর ওপর চাপ অব্যাহত রাখে যেন তাদের ক্ষমতায় রাখা যায়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় শতাধিক শিশু হত্যার শিকার হয়। দেড় হাজারের বেশি লোক মারা যায়। এক ব্যক্তিকে (শেখ হাসিনা) ক্ষমতায় রাখতে গোটা জাতিকে হত্যা করতে তারা দ্বিধা করেনি।
তাদের বিষয়েও তদন্ত শেষ করতে দুই মাস সময় চেয়ে আবেদন করা হয়। আদালত তদন্ত শেষ করতে এক মাস সময় দেন।
ট্রাইব্যুনালে যেমন ছিলেন আসামিরা-
এদিন সকাল ১০টায় একাধিক প্রিজন ভ্যানে করে ১৩ আসামিকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। দীপু মনি ব্যতীত ১২ জনকে ১২২নং কক্ষে রাখা হয়। দীপু মনিকে রাখা হয় অন্য কক্ষে। ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে আসামিদের এজলাসে আনা হয়। সেখানে আসামিদের বসার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে তারা বসেন। এসময় হাসানুল হক ইনু ও বিচারপতি মানিককে হাস্যোজ্জল দেখা যায়। সালমান এফ রহমান তার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেন। দীপু মনি অধিকাংশ সময় গালে হাত দিয়ে চিন্তিত মনে বসে ছিলেন। কামাল আহমেদ মজুমদার তিন/চার বার দাঁড়িয়ে ‘মাননীয় আদালত’ বলে বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। তবে তাকে থামিয়ে দেন পুলিশ সদস্যরা।
আনিসুল হক বারবার তৌফিক-ই-এলাহীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। সিনিয়র আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী আনিসুল হকসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন। ১২টা ৮ মিনিটের দিকে আদালতের কার্যক্রম শেষ হয়।
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।