
ফাইল ছবি
দেশের উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়িয়েছে। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে সহায়ক কর্মচারীদের অসহযোগিতা ও অবহেলা অন্যতম কারণ বলে উঠে এসেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।
সাধারণ নাগরিক, আইনজীবী, বিচারক ও সংশ্লিষ্টরা কমিশনকে জানিয়েছেন, মামলার রায় সময়মতো স্বাক্ষর না হওয়া, বেঞ্চ পুনর্গঠনে সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকা, চেম্বার আদালতে মামলার অতিরিক্ত চাপ ও আবেদনকারী পক্ষের শুনানিতে অনুপস্থিতির কারণে বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘ হচ্ছে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আট সদস্যের কমিশন সরকারপ্রধানের কাছে ৩৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন তুলে দেয়। এতে বিচার বিভাগের সমস্যা ও সংস্কার নিয়ে ৩১টি অধ্যায়ে সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। বিচারাধীন মামলা নিষ্পত্তিতে ১৫ দফা সুপারিশ বা প্রস্তাবন তুলে ধরেন।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন সুপ্রিম কোর্টের মামলা ব্যবস্থাপনা ও আদালত পরিচালনার বিভিন্ন বিষয়ে মতামত সংগ্রহের জন্য তার ওয়েবসাইটে আহবান জানায়। পাশাপাশি, অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা, ইমেইল ও চিঠির মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিক, বিচারক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সংগঠনের মতামত গ্রহণ করা হয়। এসব মতামত এবং কমিশনের সদস্যদের অভিজ্ঞতার আলোকে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে মামলার নিষ্পত্তি বিলম্বিত হওয়ার কারণ ও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়।
সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব প্রতিবেদন অনুযায়ী ৩০ জুন ২০২৪ পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৯০১ ও হাইকোর্ট বিভাগে ছিল ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৮০টি। বিচারকের সংখ্যা ও বিচারাধীন মামলার তুলনা করলে উচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতার কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি কার্যকর বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে মামলা ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার জরুরি। এ ক্ষেত্রে মামলার শুরু থেকে নিষ্পত্তি পর্যন্ত কার্যপ্রক্রিয়া, প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, জনবল ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
হাইকোর্ট বিভাগে মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতার কারণ-
১. নোটিশ জারিতে বিলম্ব ও তদারকির অভাব – মামলার শুরুতে নোটিশ জারি করতে দেরি হয় ও কার্যকরভাবে তা তদারকি করা হয় না।
২. নিম্ন আদালতের রেকর্ড দাখিলে দেরি – নিম্ন আদালতের নথিপত্র যথাসময়ে হাইকোর্টে পৌঁছায় না। ফলে মামলার অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়।
৩. প্রতিপক্ষের জবাব দাখিলের বাধ্যবাধকতা নেই – আদালতের প্রাথমিক আদেশে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে প্রতিপক্ষকে জবাব দিতে বাধ্য করা হয় না।
৪. সরকার পক্ষের দীর্ঘসূত্রিতা – মামলা পরিচালনায় সরকার পক্ষ সময়ক্ষেপণ করে। যা বিচারপ্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করে।
৫. আদালতের তদারকির অভাব – অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে আদালতের কার্যকর তদারকি নেই।
বেঞ্চ পুনর্গঠনে নীতিমালার অভাব – সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকায় বেঞ্চ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা দেখা যায়।
৬. চূড়ান্ত শুনানির জন্য তালিকাভুক্ত মামলা বাদ পড়া – আদালতের দৈনিক কার্যতালিকা থেকে অনেক মামলাই শুনানির আগেই তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়। যা বিচারপ্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করে।
৭. আদেশ ও রায় স্বাক্ষরে বিলম্ব – আদালতের রায় ঘোষণার পর তা স্বাক্ষর করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।
৮. সহায়ক কর্মচারীদের অসহযোগিতা ও অবহেলা – মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে আদালতের কর্মচারীরা অসহযোগিতা করেন ও দায়িত্ব পালনে অবহেলা দেখান।
৯. আবেদনকারী পক্ষের অনুপস্থিতি – চূড়ান্ত শুনানির সময় আবেদনকারী উপস্থিত না থাকায় মামলা খারিজ হয়। পরে তা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে বিচারপ্রক্রিয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্ব সৃষ্টি হয়।
আপিল বিভাগে মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতার কারণ-
১. শুনানির জন্য পর্যাপ্ত বেঞ্চের অভাব – অধিকাংশ সময় আপিল বিভাগে শুনানির জন্য একাধিক বেঞ্চ না থাকায় মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হয়।
২. চেম্বার আদালতে মামলার অতিরিক্ত চাপ – চেম্বার আদালতে প্রচুর মামলার জমায়েতের ফলে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিতে যথাযথ শুনানির সুযোগ কমে যায়।
৩. রিভিউ আবেদনে বিলম্ব – নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও সরকার পক্ষ রিভিউ আবেদন দায়েরের প্রবণতা বজায় রাখে। যা মামলার নিষ্পত্তি দীর্ঘায়িত করে।
৪. রায় স্বাক্ষরে বিলম্ব – আপিল বিভাগের অনেক রায় নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় না। ফলে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি বিলম্বিত হয়।
৫. রিভিউ আবেদনের মাধ্যমে মামলা ঝুলিয়ে রাখা – রিভিউ আবেদন দাখিল করা হলেও অন্তর্বর্তীকালীন কোনো আদেশ না থাকায় মামলার বিষয়টি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঝুলে থাকে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের ১৫ দফা সুপারিশ-
১. মামলা ব্যবস্থাপনা ও শুনানির প্রক্রিয়া দ্রুততর করা, ২. অনলাইনে মেনশন-স্লিপ ও বেঞ্চ পুনর্গঠনের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, ৩, মামলা নিবন্ধনে প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণ, ৪. অনলাইনে মামলার ফলাফল আদেশ ও রায় প্রকাশ, ৫. তৃতীয়পক্ষ মামলায় অন্তর্ভুক্ত হতে চাইলে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা, ৬. বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ, ৭. মামলার গুণাগুণ বিবেচনায় রায় প্রদান নিশ্চিত করা, ৮. মামলা নিষ্পত্তির জন্য প্রাসঙ্গিক অন্যান্য নির্দেশ প্রদান করা। ৯. হাইকোর্ট বিভাগের নজরদারি কমিটির কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা, ১০. হাইকোর্ট বিভাগে অপ্রয়োজনীয় মামলা হ্রাসের উদ্যোগ গ্রহণ, ১১. আপিল বিভাগের চেম্বারে শুনানি ও আদেশের কার্যকারিতা বৃদ্ধি, ১২. লিভ পিটিশন ও রিভিউ পিটিশনের নামে অযথা সময়ক্ষেপণ বন্ধ করা, ১৩. আপিল বিভাগে আইনজীবী নিবন্ধনের কার্যক্রম আরও সুসংগঠিত করা ১৪, আদালত ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বাংলায় সহজবোধ্য ম্যানুয়াল তৈরি ও প্রকাশ, ১৫. বর্তমানে ইংরেজিতে থাকা জটিল ও দীর্ঘ বর্ণনার পরিবর্তে সহজ ভাষায় নির্দেশিকা প্রদান।
আপন দেশ/এমবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।