ছবি: সংগৃহীত
মেকআপ ছাড়া বাইরে যান এমন নারী খুঁজে পেলেও লিপস্টিক ব্যবহার করেন না এমন নারীর দেখা মেলা ভার। নারীর সাজের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে লিপস্টিক। খুব সুন্দর করে সেজে লিপস্টিক না পরলে সেই সাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায় যেন। তাই প্রিয় ঠোঁটজোড়া রাঙাতে ভালোবাসেন প্রায় সব নারীই। শুধু সৌন্দর্যবর্ধন নয়, ব্যক্তিত্বের বিকাশেও ভূমিকা রাখে লিপস্টিক।
গত কয়েক বছরে লিপস্টিকের বেলায় সবচেয়ে বড় যে বদল চোখে পড়ছে তা হলো এর রঙের বিচিত্রতা। একসময় লিপস্টিকের রং বলতে কেবল টকটকে লাল, বড়জোর মেরুন- এই-ই বুঝত মেয়েরা। হালের তরুণীরা নিজেরাই একেকজন স্টাইল ক্রিয়েটর। তারা ত্বকের রঙে মিলিয়ে যেমন পরছেন বর্ণহীন ন্যুড, আবার ইচ্ছা হলেই ঠোঁটে বোলাচ্ছেন একেবারে কন্ট্রাস্ট, উজ্জ্বল কোনো রঙের লিপস্টিক।
প্রাচীন মিশরীয়রা রঞ্জক পদার্থ যেমন অ্যালজিন, আয়োডিন ও ব্রোমিনের মিশ্রণে লাল রঙ তৈরি করে লিপস্টিক ব্যবহার করত। ফারাও রাণী ক্লিওপেট্রা গাঢ় লাল রঙ ব্যবহার করতেন ঠোঁটে, যা তৈরি হতো মেরুন রঙের বিটল পোকা থেকে। এর ফলে ঠোঁটে একটি গাঢ় লাল আভা ফুটে উঠতো। সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক লিপস্টিক উৎপাদনে ফ্রান্সের নাম উঠে আসে। ১৮৮০ সালে প্যারিসে সুগন্ধি শিল্পেই তৈরি হয় বাণিজ্যিক লিপস্টিক। ১৮৯০ সালের শেষদিকে ইউরোপ এবং আমেরিকা জুড়ে লিপস্টিক বিক্রি করা শুরু হয় এবং এর প্রসারে বিজ্ঞাপন প্রচারও শুরু হয়।
নারীরা লিপস্টিক ব্যবহার কেন?
অনেক নারী তাদের ঠোঁটের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য লিপস্টিক পরে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে সেই প্রাণবন্ত ভাব কমে আসতে শুরু করে। নারীর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটের রঙ হারায়। যে কারণে কিছু নারী নিজেকে তরুণ দেখাতে লিপস্টিক পরে। এছাড়াও লিপগ্লস এবং লিপ লাইনার ঠোঁটে বাড়তি সৌন্দর্য যোগ করতে পারে। নারী ঠোঁটকে আকর্ষণীয় দেখাতে লিপস্টিক পরে এবং এর ফলে সে আরও আত্মবিশ্বাসী বোধ করে।
কোনো কোনো নারী আত্মবিশ্বাস বাড়াতে মেকআপ করেন। যেমন লিপস্টিক ব্যবহারের পর শব্দ উচ্চারণে তারা আরও স্মার্ট থাকার চেষ্টা করেন। একজন নারী যে ধরনের লিপস্টিক পরেন তা তার আত্মসম্মানকে প্রভাবিত করতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে উজ্জ্বল রঙের লিপস্টিক মানসিক শক্তি দেয়। অনেক নারী লিপস্টিক পরলে বেশি আত্মবিশ্বাসী বোধ করেন। তবে কিছু নারী আবার অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লিপস্টিক পরতে পছন্দ করেন।
অনেক নারীর ক্ষেত্রেই লিপস্টিক ব্যবহারের কারণ হিসেবে ব্যক্তিগত পছন্দ ছাড়া অন্য কোনো কারণ থাকে না। কোনো কোনো নারী সব সময়ই লিপস্টিক পরতে পছন্দ করে। অনেক নারী বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য হালকা রঙের লিপস্টিক পরে যাতে তাদের ঠোঁটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বজায় থাকে। রাতের অনুষ্ঠানে আবার অনেক নারী একটু গাঢ় রঙের লিপস্টিক পরতে পছন্দ করে।
লিপস্টিক প্রস্তুতকরণের প্রক্রিয়া
লিপস্টিক তৈরিতে মূলত চারটি উপাদান ব্যবহার করা হয়। এগুলো হচ্ছে মোম, তেল, রঞ্জক এবং অ্যালকোহল। লিপস্টিকে দেওয়া মোম ও তেলের অনুপাত- রঞ্জক পদার্থ এবং অ্যালকোহলের অনুপাতের তুলনায় বেশি হয়ে থাকে। প্রথমে তেল, মোম এবং অ্যালকোহল এই তিনটি মৌলিক উপাদান গলানো হয়। এবং এগুলোকে একত্রে মিশ্রণ করে লিপস্টিকের বেস তৈরি করা হয়। এরপর সেই গলিত বেজে পিগমেন্ট বা রঞ্জক পদার্থ যুক্ত করা হয়। একেকটি রঙ এবং শেডের জন্য বিভিন্ন পরিমাণে রঞ্জক ব্যবহার করা হয়। এই রঞ্জকগুলো তরল বা পাউডার যেকোন ধরণেরই হতে পারে।
মিশ্রণটি কোমল হওয়ার জন্য এবং যাতে দলা পাকিয়ে না থাকে এ কারণে একটি রোলার মেশিন দ্বারা একে ভালোভাবে রোলিং করা হয়। রোলার মেশিন মিশ্রণ থেকে অতিরিক্ত তেল বের করে ফেলে। যে কারণে রোলিং মাধ্যমে মিশ্রণটি সামান্য কঠিন আকার ধারণ করে। আর একইসঙ্গে একটি স্মুদ টেক্সচারে পরিণত হয়।
এরপর সম্পূর্ণ মিশ্রণটি বড় একটি পাত্রে ঢালা হয়। যেখান থেকে এগুলোকে ছোট ছোট ব্যাচে বিভক্ত করা হয়। এরপর মিশ্রনটি আবার গলানো হয় এবং এতে সুগন্ধী মেশানো হয়। তারপর গলিত দ্রব্য একটি ধাতব ছাঁচে ঢালা হয় যেটায় লিপস্টিকের প্রকৃত আকার অনুযায়ী একসঙ্গে অনেকগুলো ফাঁকা স্টিক থেকে থাকে।
লিপস্টিক ব্যবহারের উপকারিতা
লিপস্টিক যে শুধু ঠোঁটের বা মুখের সৌন্দর্যই বাড়ায়, তা-ই নয় বরং ঠোঁট আর্দ্র এবং নরম রাখতেও লিপস্টিক ব্যবহার করা যায়। ক্রিম লিপস্টিক, আর্দ্র লিপস্টিক বা গ্লসি লিপস্টিক ঠোঁটকে নরম রাখে এবং ফাটল থেকে ঠোঁটকে সুরক্ষিত করে। যদিও এমন শোনা যায় যে অতিরিক্ত লিপস্টিক ব্যবহারে ঠোঁটের চামড়ার ক্ষতি হয়, কিন্তু ভালো ব্র্যান্ডের লিপস্টিক ব্যবহারে ঠোঁটকে ভালো রাখা যায়। কিছু কিছু লিপস্টিক সূর্যের ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি থেকেও ঠোঁটকে রক্ষা করে।
লিপস্টিক ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক
লিপস্টিকে একাধিক ক্ষতিকারক পদার্থ থাকে। অতিরিক্ত লিপস্টিকের ব্যবহারে ঠোঁটের লোমকূপ ছোট হয়ে যেতে পারে, যেটি ঠোঁটের চামড়ার নমনীয়তা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। অনেক সময় এটি ঠোঁটকে শুষ্ক করে ফেলে এবং ক্ষেত্র বিশেষে ঠোঁট তার নিজস্ব রং এবং স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে। বেশি লিপস্টিক ব্যবহার করলে অনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে। প্রথমে সমস্যা শুরু হয় ঠোঁট চুলকানো দিয়ে। এরপরে ক্রমশ ঠোঁট কালো হয়ে যেতে পারে।
তবে চিকিৎসকরা বলছেন, সব লিপস্টিকের ক্ষেত্রে এই যুক্তি খাটে না। কারও যদি আগে থেকেই ঠোঁটের সমস্যা থাকে, সে ক্ষেত্রে পুরোপুরি লিপস্টিককে দায়ী করা যায় না।
বিভিন্ন গবেষণায় লিপস্টিক ও লিপগ্লসে সিসা ছাড়াও ক্যাডমিয়াম, কোবাল্ট, অ্যালুমিনিয়াম, টাইটানিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ়, ক্রোমিয়াম, কপার, নিকেলের মতো ধাতুর অস্তিত্ত্ব পাওয়া গিয়েছে। যদিও তার মাত্রা খুব একটা বেশি নয়, তবুও দিনের পর দিন তা ব্যবহারের বিপক্ষেই সায় দেন বেশিরভাগ পরিবেশবিদ ও ত্বক বিশেষজ্ঞরা।
এমন কিছু লিপস্টিক রয়েছে, যা ঠোঁটকে শুষ্ক করে তুলতে পারে। আবার যাদের শুষ্ক ত্বকের সমস্যা রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা গুরুতর হয়ে যেতে পারে। তবে যে সমস্ত লিপস্টিক তৈরিতে বিভিন্ন ধরনের তেল, মাখন ব্যবহার করা হয়, সেগুলি ঠোঁটের আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
লিপস্টিক ব্যবহারে অনেকের ঠোঁট কালো হওয়া থেকে শুরু করে এলার্জির সমস্যাও হয়ে থাকে। তাই গুণগত বৈশিষ্ট্য না জেনে লিপস্টিক ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। এজন্য লিপস্টিক ব্যবহারের সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি।
আপন দেশ/এসএমএ