ফাইল ছবি
যৌবন, প্রেম বা নারী আর যুদ্ধ— ত্রিসত্তায় কবিতা হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত, জীবন্ত। হেলাল হাফিজ (জন্ম: ৭ অক্টোবর ১৯৪৮) ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যের কবিতাগুলোর মূলসুর এই তিন মিলেই। সময় বড় ফ্যাক্টর। প্রেম আর যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো নিয়ম মানে না, মানে না আইন। হেলাল হাফিজ কিন্তু স্বাধীনতা অর্জন বা এ সত্তা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রেমকে বা নারীকে পাশে রেখে যুদ্ধকেই সম্মুখে রেখেছেন। নারীর প্রেম, স্বাধীনতা, যুদ্ধ, গোলাপ ইত্যাদি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তার কবিতায়। মর্যাদা পান প্রেম ও দ্রোহের কবি হিসেবে। একই কবিতায় রোমান্টিসিজম, ব্যক্তিত্ব ও যুদ্ধ প্রভৃতির অনুষঙ্গ একত্রেই পাওয়া যায়। এ গুণ বিরলই বটে। এমনকি বিশ্বসাহিত্যেও প্রায় বিরল।
কবি হেলাল হাফিজের কবিতায় চিত্রকল্প কম হলেও সহজ-সরল ভাষায়। চিরচেনা পরিবেশ থেকে। উপমা ও প্রতিতুলনার বিষয়াদি সাধারণ হলেও পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে সহজেই। ‘চতুর সুদর্শনা’, ‘চিকন বিড়ম্বনা’ উপমায় নতুনত্ব পাঠককে সহজেই মুগ্ধ করে। এসবক্ষেত্রে হেলাল হাফিজ আলাদা ফ্লেভার তৈরি করেছেন। ‘তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো?/পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো (অমিমাংসিত সন্ধি)’, ‘তুমিই তো অসময়ে অন্ধকারে/অন্তরের আরতির ঘৃতের আগুনে পুড়বে নির্জনে।/আমাকে পাবে না খুঁজে, কেঁদে-কেটে, মামুলী ফালগুনে (আমার কী এসে যাবে)’, ‘একবার ডাক দিয়ে দেখো আমি কতোটা কাঙাল,/কতো হুলুস্থূল অনটন আজন্ম ভেতরে আমার।/...একবার আমন্ত্রণ পেলে/সব কিছু ফেলে/তোমার উদ্দেশে দেবো উজাড় উড়াল (তুমি ডাক দিলে)’, ‘কিছুই পারিনি দিতে, এই নাও বাম হাত তোমাকে দিলাম (বাম হাত তোমাকে দিলাম)’, ‘কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি (যাতায়াত)’, ‘একাই ছিলাম আমি পুনরায় একলা হলাম (শামুক)’, ‘অপুষ্টিতে নষ্ট প্রেম’, ‘কচি প্রেমের পত্র’, ‘পতন দিয়েই আমি পতন ফেরাবো’, ‘সবুজ সকালে’, ‘লাল কষ্ট নীল কষ্ট হলুদ রঙের কষ্ট’, ‘তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছো’, ‘আঙুল দিয়ে আঙুল ছুঁয়েছিলাম’, ‘আঙুলে সুর এসেছে’, ‘উত্তর পুরুষ ভীরু কাপুরুষের উপমা হবে’ ইত্যাদির মতো শব্দ বা শব্দশৈলী ব্যবহার করেছেন। এসব প্রয়োগ ও ব্যবহারে নতুনত্ব রয়েছে। পাঠক সবসময় নতুনত্বকে বরণ করতেই পছন্দ করে। কবিতায় নতুনত্ব আচারের মতো আচরণ করে। আচার বা সালাদ যেমন রুচিকে বাড়িয়ে দেয় তেমনই কবিতায় নতুন শব্দের ব্যবহার পাঠকের রুচিকে বাড়িয়ে দেয়, একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দেয়। চারিপাশের চেনা ও সহজ-সরল অথচ ব্যবহারে নতুনত্ব শব্দ বা উপাদানের ব্যবহার হেলাল হাফিজের জনপ্রিয়তাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
কবি হেলাল হাফিজ নারীকে শুধু রক্তমাংসের ভাবেননি, বিরাট শক্তির আধার ভেবেছেন। নারীকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন হিসাব মিলিয়ে নিতে চেয়েছেন। নারী কখনো বিনোদনের সঙ্গী, কখনো বা অভিযানের সারথি। আবার জীবনযন্ত্রণাকারীও ভেবেছেন। নারীর মধ্যে তিনি খুঁজে পান অপার সৌন্দর্য। হেলেন যেমন ট্রয়নগরী ধ্বংসের জন্য কারণ বলে মনে করা হয়। কবি হেলাল হাফিজ কিন্তু এ বাস্তবতাও মনে রেখেছেন। পুরুষজীবনে সৌন্দর্য বিলানো বা চলার সঙ্গী হিসেবে যেমন গৌরবময় হতে পারে আবার ছলনার জালেও ফেলতে পারে— এ দ্বৈতসত্তা কবির কবিতায় উঠে এসেছে। আর এটাই কিন্তু বাস্তবতা। বাস্তবতাকে অস্বীকার করে অতি আবেগ ঢেলে দেননি। তার এ মানসচিন্তার প্রতিফলন তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে বলে মনে করি। সর্বানুভূতি ও সৌন্দর্যবোধের যুগল সমন্বয়ে এক নতুন প্রেমমূর্তিই নবজন্ম দান করেছে। অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি ইত্যাদির মিশেলে প্রেমচেতনার বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে পেরিয়ে কবিতায় এনেছেন বহুমুখীনতা। প্রেম, বিরহ ও বিদ্রোহর নানান স্তরভেদ করে গড়ে তুলেছেন এক সমৃদ্ধ কাব্যসম্ভার; যা পাঠককে করছে বিনোদিত ও প্রাজ্ঞ। কবি সুন্দর ও কল্যাণের পথে হেঁটেছেন। মঙ্গল কামনা করেছেন দেশের, প্রেমের। এক্ষেত্রে তিনি যা-বলার তা সরাসরিই বলেছেন। কোনো রাখ ঢাক করেননি। তিনি প্রেমের জয়গান গেয়েছেন কিন্তু নিজে চিরকুমার থেকেছেন। যাযাবর জীবনযাপন করেছেন। শেষের জীবনে একা একা হোটেলেই থাকছেন। তাহলে ‘তিনি প্রেমের যে জয়গান গাইলেন’ কাদের জন্য? নিজেকে বঞ্চিত কেন করলেন? এসবের ব্যখ্যা করা মুশকিল!
আগেই বলেছি, কবি হেলাল হাফিজের কবিতায় চিত্রকল্পের ঘাটতি (কম) রয়েছে। উপমা বা বিভিন্ন অলংকারের ভারে ভারাক্রান্ত হয়নি বা খুবই কম সজ্জিত হয়েছে। আধুনিক যুগের কবিতা চিত্রকল্পের কদর বেশি। তার অনেক কবিতা শ্লোগানধর্মী-বিভিন্ন আন্দোলন ও অভিযানে অনুপ্রেরণার কাজ করে। তিনি অনেক কম কবিতা প্রকাশ করেই গল্প হচ্ছেন, প্রধান কবিদের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছেন। ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’র মতো কিছু কিছু ছত্র প্রবাদতুল্য মর্যাদা পেয়েছে। শুদ্ধ মানবতাবোধ ছিল হেলালের কবিতায়। ক্লান্তিহীন সংগ্রাম ও যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই প্রেমের অমৃতলোক জয়ের চিন্তা করেন। মননে ঋদ্ধ, চেতনায় স্বাধীনতা নিয়ে স্বচ্ছ ও সঙ্গীতের ঝংকার নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হন কবি হেলাল হাফিজ। এই কবির কবিতা পাঠকের মননকে আন্দোলিত করে, বশীভূত করে। হেলাল হাফিজের কবিতায় একইসঙ্গে প্রেমের ও দ্রোহের কথা বলে। আবার মানবতা-অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রামের কথা বলে। প্রেম-বিরহ-দ্রোহ-মানবতা-সংগ্রাম— এই পঞ্চসত্তা-কবি হেলাল হাফিজের কবিতায় বিরাজমানÑমাঝেমধ্যে একটি কবিতাতেই। এই সবকয়টা সত্তা সমানভাবে সক্রিয় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ‘এক অঙ্গে অনেক রূপ’ গুণ কবিকে অন্য কবিদের থেকে পৃথক করেছে। যা বিশ্বসাহিত্যেও কম লক্ষ করা যায়। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় কবি হেলাল হাফিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। এরপর দীর্ঘ ৩৪ বছর পর প্রকাশিত হয় হেলাল হাফিজের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। ২০১২ সালে ‘কবিতা একাত্তর’ ও ২০১৯ সালে ‘এক জীবনের জন্ম যখন’ প্রকাশিত হয়। এগুলো মূলত দ্বিভাষিক বই। সে অর্থে ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ তার দ্বিতীয় মৌলিক বই। প্রেম, বিরহ ও প্রযুক্তির প্রভাব মিলিয়ে নতুন একটা সুর তিনি তৈরি করতে চেয়েছেন।
চিরযৌবনা কবি হেলাল হাফিজ। প্রেমই তার কবিতার মূলসূত্র। এ সূত্র ধরেই আবার তিনি যৌবনকে যুদ্ধে যাওয়ার মন্ত্র দিয়েছেন। প্রেমকেই অনুষঙ্গ রেখেই সমাজ ও বৈষম্য, চাহিদা, অপূর্ণতা, হতাশার চিত্র ফুটে উঠেছে। ছোট ছোট কবিতায় খণ্ড খণ্ড চিত্র তুলে এনেছেন। তার প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা অনেক বেশিও নাÑ তুলনামূলক অনেক কম। তবে কম সংখ্যক কবিতার মাধ্যমেই তিনি কবিতার গল্প হয়েছেন, কবিতার বরপুত্র হয়েছেন। বর্তমানের আলোচিত কবিকূলের শিরোমণি তিনি।
আপন দেশ/আরএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।