ফাইল ছবি
‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’- কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পঙ্ক্তি। আধুনিক কোনো কবি বলতে পারেন— মনে নিরানন্দ, তাতে কী? আজ বসন্ত, পহেলা ফাল্গুন। যুদ্ধ আর হানাহানিতে বিশ্ব ধুঁকছে। এসবের প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। তারপরও বাসন্তী ছোঁয়া ফিকে হবে না। কারণ প্রাণের শিহরণ মানে না কোনো বাঁধন।
এবার আরেকটি বিষয় খুবই মজার। বসন্ত শুরু ও ভালোবাসার দিন একাকার হয়ে গেছে। তাই বসন্তের সঙ্গে আজ ভালোবাসারও দিন; হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন’স ডে। বসন্তের আগমনী বার্তায় ফাগুন হাওয়ার দোল লেগেছে বাংলার নিসর্গ প্রকৃতিতে। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠছে সবুজ অঙ্গন। মাঘের শেষ দিক থেকেই গাছে গাছে ফুটছে আমের মুকুল। শীতের খোলসে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্কন এখন জেগে উঠতে শুরু করেছে। মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধ জানিয়ে দিচ্ছে বসন্ত এসেছে এবং সত্যি সত্যি ঋতুর রাজা। ‘ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল/ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ফাল্গুন কবিতার কয়েকটি পঙক্তি।
১৪৩০ বঙ্গাব্দের শেষ ঋতু বসন্তের প্রথম দিন পহেলা ফাল্গুনের মানসপটে বারবার হানা দিচ্ছে কবিগুরুর এ ‘ফাল্গুন’। ঋতুরাজ বসন্ত আবাহনের ক্ষণযাত্রা। ফুলেল মধুময় ও যৌবনের উদ্যামতা বয়ে আনার বসন্ত, উচ্ছ্বাস ও উদ্বেলতায় মন-প্রাণ কেড়ে নেওয়ার বসন্ত। স্বাগত বসন্ত। প্রাণ খুলে তাই যেন কবির ভাষায় বলা যায়, ‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে/এত বাঁশি বাজে/এত পাখি গায়।’ কোকিলের কুহুতান, দখিনা হাওয়া, ঝরা পাতার শুকনো নূপুরের নিক্কন, প্রকৃতির মিলন এ বসন্তেই।
বসন্ত মানেই যে পূর্ণতা। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব। বসন্ত মানেই একে অপরের হাত ধরে হাঁটা। মিলনের এ ঋতু বাসন্তী রঙে সাজায় মনকে, মানুষকে করে আনমনা। এমন ফাল্গুনেই, বায়ান্নর আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশরাঙা দিনে তারুণ্যের শব্দ বিপ্লব, সাহসী উচ্ছ্বাস ও বাঁধভাঙা আবেগে বাংলা একাকার হয়েছিল। বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি অনাদিকাল থেকেই। কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায় আছে বসন্তের বন্দনা। সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই করে নিয়েছে নানা অনুপ্রাস, উপমা ও উৎপ্রেক্ষায়। গ্রামের মেঠোপথ, নদীর পাড়, গাছ, মাঠভরা ফসলের ক্ষেত বসন্তের রঙে রঙিন। চোখ বুজলেও টের পাওয়া যায় এমন দৃশ্যপট।
নাগরিক ইটপাথরের জীবনে বসন্ত এসেছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ হয়ে। এমন ক্ষণে চলছে অমর একুশে বইমেলা; যা বসন্তের আবহকে নতুন মাত্রা দেবে। বাসন্তী এমন দিনে রমণীরা রাঙিয়ে তুলবে রাজপথ, পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশোভিত সবুজ চত্বরসহ পুরো নগরী। কংক্রিটের নগরীতে কোকিলের কুহুস্বর ধ্বনিত হবে ফাগুনের আগমনে।
একইসঙ্গে আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবস। শুধুই ভালোবাসার দিন। ফাগুনের প্রথম প্রহরে আজ উদযাপিত হচ্ছে ভালোবাসা দিবস। প্রতিবারের মতো এবারো দিবসটিকে ঘিরে মনে মনে লেগেছে আনন্দের ঢেউ।
ভ্যালেন্টাইনস ডে-র পাশ্চাত্য প্রভাব নিয়ে নাক সিঁটকানো মানুষরাও আজকের দিনে বেশ উদার। অবশ্য ভালোবাসা দিবসের সময়টি এখন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই দিবসটি এমন সময়ে পালিত হয়, যখন বাংলাদেশে বসন্ত ঋতুর আবির্ভাব ঘটে।
যতদূর জানা যায়, ১৯৯৩ সালের দিকে আমাদের দেশে ভালোবাসা দিবসের আবির্ভাব ঘটে। দিবসটি প্রচলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমান। তার সাহচর্যেই ভালোবাসা দিবস আজকের রূপে।
ইতিহাসে আধ্যাত্মিক বা রহস্যময় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন সম্পর্কে জানা গেছে, তাদের মধ্যে আলেকজান্দ্রিয়ার সাধক ভ্যালেন্টাইন (১০০-১৫০) ইতিহাসে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। তিনি ছিলেন রহস্যময় শিক্ষক ও ১৪৩ সালে ‘বিশপ অব রোম’ পদের একজন শক্তিশালী প্রার্থী। তার ভালোবাসার রূপে বিয়ে প্রাধান্য পেয়েছে। খ্রিস্টধর্মের মৌল চেতনায় কঠোর তপস্যা ও কৌমার্যব্রত পালনকে তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। পরকালে দায়মুক্তির কনসেপ্টের চেয়ে বাসরঘরই তার কাছে শ্রেয় ছিল। জার্মান পণ্ডিত গুয়েবার স্ক্যান্ডেনেভিয়ান অঞ্চলের দেবতা ভ্যালির সম্পর্কে লিখেন- ‘ভ্যালি হচ্ছেন চিরন্তন আলোর উৎস’। যেমন করে ডিভার হচ্ছে, এমন বস্তু যাকে কোনোদিনও ধ্বংস করা যাবে না।
আলোক রশ্মিকে যেমন তীর হিসেবে বর্ণনা করা, তেমনই দেবতা ভ্যালিও সবসময় তীরের প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন। এ কারণে নরওয়েবাসী ফেব্রুয়ারি মাসের ক্যালেন্ডারটিতে ধনুকের চিহ্ন রাখবেই। আর এটির নাম ‘লিয়া-বেরি’- মানে আলো আনয়নকারী। একসময় জার্মানির খ্রিস্টানরা ফেব্রুয়ারি মাসটিকে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের জন্য উৎসর্গ করে দেশের উপজাতিদের ধর্মীয় আচার পালন থেকে বিরত থাকতে বারণ করতো। বলা হয়ে থাকে, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন দেবতা ভ্যালির মতোই দক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন।
ইতিহাসে রয়েছে- ফেব্রুয়ারির সঙ্গে ভালোবাসা ও উর্বরতার সম্পৃক্ততার প্রমাণটিও নাকি বেশ প্রাচীন। প্রাচীন গ্রিক ক্যালেন্ডারে মধ্য জানুয়ারি থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়টির নাম হয়েছে থ্যামিলিয়ন। আর প্রাচীন রোমে ১৫ ফেব্রুয়ারিকে বলা হতো লিউপারক্যালিয়া। পোপ গ্যালাসিয়াস (৪৯২-৪৯৩) লিউপারক্যালিয়া উৎসব বাতিল ঘোষণা করেন। তবে পোপ ৪৯৬ সালে ঘোষণা দেন, ১৪ ফেব্রুয়ারি সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’স ডে পালিত হবে।
সেই থেকে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’স ডে। অর্থাৎ ভালোবাসা দিবসের শুরু। জানা যায়, তিনজন খ্রিস্টান শহীদ ভ্যালেন্টাইনের নামে দিবসটি পালন শুরু হয়। তবে তাদের মধ্যে কে প্রকৃত ভ্যালেন্টাইন ছিলেন এ নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। রয়েছে নানামাত্রার আখ্যান। রয়েছে নানাজনের নানা মত। তবে গল্প কিংবা বিতর্ক যাই থাকুক, ভ্যালেন্টাইন’স ডে এখন আর কোনো নির্দিষ্ট গোত্র বা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। গোটা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছে তার আবাহন। যার গভীরে লুকিয়ে রয়েছে ভালোবাসার সবুজবার্তা।
অন্তত এই একটি দিনেও যদি মানুষের মধ্যে শান্তি ও সদ্ভাব ফিরে আসে, তা হলে মন্দ কী? কারণ আমরা চাই, সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে মৈত্রী ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হোক পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ। রচিত হোক মহামিলনের মহাকাব্য। ভালো থাকুক ভালোবাসা। ভালোই থাকে ভালোবাসা।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।