ফাইল ছবি
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী এ দেশকে দিয়েছে ভিন্ন আবহ। বিশ্বের প্রতিটি সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকে ঘিরে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। এ দেশের প্রতিটি অঞ্চল নদীর দ্বারা স্বয়ংসম্পূর্ণ। নদী বাঙালিকে করেছে স্বয়ম্ভু। কৃষ্টি-সৃষ্টিতে করেছে সমৃদ্ধ।
প্রতিটি মানুষের জীবনপ্রবাহ ঘিরে রয়েছে একেকটি নদী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি গর্বিত জেলা; শিল্প-সাহিত্যের সব শাখায়। আর এর পেছনে একটি নদী; তিতাসের অবদান সর্বাগ্রে। উইকিপিডিয়া বলছে, তিতাস বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাংশে প্রবহমান নদীবিশেষ। বাংলাদেশ-ভারতের আন্তসীমানা-সংশ্লিষ্ট নদী হিসেবে এটি পরিচিত। নদীটির উৎপত্তি হয়েছে ভারতের অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরায়। সেখানে বাংলা ভাষায় হাওড়া নদী এবং স্থানীয় কোকবোরোক ভাষায় সাঈদ্রা নদী নামে তিতাস নদীর নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ওই নদীটি তিতাস নদী হিসেবে পরিচিতি পায়। ভারতীয় অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার কাছাকাছি প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলা দিয়ে নদীটি প্রবেশ করে শাহবাজপুর টাউন অঞ্চলের সীমানা ঘেঁষে এটি আরো দক্ষিণদিকে অগ্রসর হয়ে ভৈরব-আশুগঞ্জের সীমানা ঘেঁষে বহমান অন্যতম বৃহৎ নদী মেঘনার সাথে একীভূত হয়ে যায় তিতাস নদীটি। তিতাসের গড় দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৮ কিলোমিটার। তিতাস ও মেঘনা নদীকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল রাষ্ট্র বাংলাদেশে অনেক উপকথা প্রচলিত আছে। একটি উপকথায় বলা হয়েছে, তিতাস নদী মেঘনার কন্যা বা মেয়ে। অনেকে বলেন, তিতাস মেঘনা দুহিতা। তাদের মতে মেঘনার শাখা নদী এটি। মেঘনা থেকে উৎপত্তি হয়ে মেঘনাতেই মিশে গেছে এটি। এর মাঝে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে গড়ে তুলেছে সে। একটি শান্ত নদী তিতাস।
তিতাস নিয়ে অনেক কিছু হয়েছে। তিতাস নদী-তীরবর্তী এলাকায় অবস্থানরত জেলে সম্প্রদায়ের বসবাস ও তাদের জীবন-সংগ্রামকে কেন্দ্র করে তিতাস একটি নদীর নাম শিরোনামে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় উপন্যাস রচনা করেছেন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ। পরে ১৯৭৩ সালে উপন্যাসের কাহিনিকে উপজীব্য করে তিতাস একটি নদীর নাম শিরোনামে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্মিক ঘটক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এ চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহের কারণ হিসেবে ঋত্বিক ঘটক বলেন, ‘তিতাস পূর্ব বাংলার একটা খণ্ডজীবন, এটি একটি সৎ লেখা। ইদানীং সচরাচর বাংলাদেশে (দুই বাংলাতেই) এ রকম লেখার দেখা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে আছে প্রচুর নাটকীয় উপাদান, আছে দর্শনধারী ঘটনাবলি, আছে শ্রোতব্য বহু প্রাচীন সংগীতের টুকরো- সব মিলিয়ে একটা অনাবিল আনন্দ ও অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করা যায়। ব্যাপারটা ছবিতে ধরা পড়ার জন্য জন্ম থেকেই কাঁদছিল।... অদ্বৈতবাবু অনেক অতিকথন করেন। কিন্তু লেখাটা একেবারে প্রাণ থেকে, ভেতর থেকে লেখা। আমি নিজেও বাবুর চোখ দিয়ে না দেখে ওইভাবে ভেতর থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। অদ্বৈতবাবু যে সময়ে তিতাস নদী দেখেছেন, তখন তিতাস ও তার তীরবর্তী গ্রামীণ সভ্যতা মরতে বসেছে। বইয়ে তিতাস একটি নদীর নাম। তিনি এর পরের পুনর্জীবনটা দেখতে যাননি। আমি দেখাতে চাই যে, মৃত্যুর পরেও এই পুনর্জীবন হচ্ছে। তিতাস এখন আবার তারুণ্যে উজ্জীবিত। আমার ছবিতে গ্রাম নায়ক, তিতাস নায়িকা।’
তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি প্রথমে মাসিক পত্রিকা মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়েছিল। কয়েকটি অধ্যায় মোহাম্মদীতে মুদ্রিত হওয়ার পর উপন্যাসটির মূল পাণ্ডুলিপি রাস্তায় হারিয়ে যায়। বন্ধু-বান্ধব ও অত্যাগ্রহী পাঠকের আন্তরিক অনুরোধে তিনি পুনরায় কাহিনিটি লেখেন। কাঁচড়াপাড়া হাসপাতালে ভর্তির আগে এই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি বন্ধু-বান্ধবকে দিয়ে যান। অদ্বৈত মল্লবর্মণের মৃত্যুর কয়েক বছর পর তিতাস একটি নদীর নাম শিরোনামের এই উপন্যাস প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
তিতাস নদীর উপকূলে প্রাপ্ত গ্যাসক্ষেত্রটি তিতাস গ্যাসক্ষেত্র নামে পরিচিত। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস উৎপাদনকারী ক্ষেত্র হিসেবে এই গ্যাসক্ষেত্র ১৯৬২ সালে পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানি আবিষ্কার করেছিল। ২০০০ সাল পর্যন্ত এখানে ১৪টি কূপ খনন করা হয়েছে। প্রায় ৬৪ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী বিস্তৃত এই গ্যাসক্ষেত্রের ভূ-গঠন গম্বুজ প্রকৃতির।
তিতাসের আবহকে ঘিরে রচিত হয়েছে কবি আল মাহমুদের একাধিক কবিতাণ্ডগল্প-উপন্যাস। তিতাসের জলে ভেসে সমৃদ্ধ হয়েছেন দেশের অনেক কবি-সাহিত্যিক-সংগীতজ্ঞ। তিতাসের বুকে আশ্রয় খুঁজেছেন শচীন দেববর্মণ বা এস ডি বর্মণের মতো বরেণ্য অনেক শিল্পী।
অদ্বৈতের ভাষা ধার করে বলতে হয়, ‘তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না। মেঘনা-পদ্মার বিরাট বিভীষিকা তার মধ্যে নাই। আবার রমু মোড়লের মরাই, যদু পণ্ডিতের পাঠশালার পাশ দিয়া বহিয়া-যাওয়া শীর্ণা পল্লীতটিনীর চোরা কাঙ্গালপনাও তার নাই। তিতাস মাঝারি নদী। দুষ্ট পল্লীবালক তাকে সাঁতরাইয়া পার হইতে পারে না। আবার ছোট নৌকায় ছোট বৌ নিয়া মাঝি কোনোদিন ওপারে যাইতে ভয় পায় না। তিতাস শাহী মেজাজে চলে। তার সাপের মতো বক্রতা নাই, কৃপণের মতো কুটিলতা নাই। কৃষ্ণপক্ষের ভাঁটায় তার বুকের খানিকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙ্গাল করে না। শুক্লপক্ষের জোয়ারের উদ্দীপনা তাকে ফোলায়, কিন্তু উদ্বেল করে না।’
তিতাসকে বন্দনা করেছেন অনেক কালজয়ী। তিতাসকে দেখছি কৈশোরকাল থেকে। যৌবনেও সে ভরসা। বৃদ্ধ বয়সেও সাথি হয়েই রবে তিতাস। সে বয়ে চলে নিরবধি। তিতাস কাব্যে-কলায় অনেককে তাড়িত করেছে। আমিও ব্যতিক্রম নই। তাইতো লিখে যাই, ‘ফাগুন বাতাসে/কথারা ওম পায়/আগুন তিতাসে ব্যথারা ঘুম যায়।’ তিতাস আলোড়ন তুলে প্রতিটি শিরায়-অস্তিত্বে- ‘একটি চরিত্র হতে চাই। কোনো বিশেষ চরিত্র নয়। আমাকে আমিই হতে হবে। এর বাইরে যাওয়া যায় কি? বক্রবিন্দুর জল গড়াচ্ছে। আমিও আলো ছড়াচ্ছি। ভাবনার দ্বৈত গোলকে। মাঝে-সাঝে জলের কল্লোল। এরই মাঝে জল ছলাৎ ছলাৎ বাতাস তোলে মেঘনা-তিতাস তীরবর্তী পড়শি ঘরে, কুপির আগুনে। চরিত্রের দাম্ভিকতায় ভাবি- আগুন অস্তিত্ব ভুলবে না। আমি হয়ে উঠেছি। গোলকে জলজ আলোর ঝিলিক।’ তিতাসের রূপালী জিলিকেই তাবৎ শিল্পী-সাহিত্যিক কাবু।
তিতাস শুধুই কি নদী। এটি একটি সভ্যতার স্বাক্ষী। এ সভ্যতার সূত্র ধরেই এগিয়ে চলি আমরা। নাগরিক হয়েও মন পড়ে থাকে তিতাস পাড়ে। সংগীতশিল্পী সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গানের কথা ধরে হলেও বছরে একবার অন্তত তিতাস নদীর কিনারে যাই। খুঁজে ফিরি কৈশোর-যৌবন। তিতাস সব দুঃখ শুষে নেয়।
তিতাস দিয়েছে বরাভয়; মন খুলে হাসি-কান্নার। তিতাস দিয়েছে আশ্রয়। তিতাস করেছে চিরকালীন ভাবুক। এ ভাব বেচেই নাগরিক জীবনযাপন। তিতাস আজীবনের সঙ্গী। কবি আল মাহমুদের ভাবের আশ্রয়ে বলতে হয়, তিতাসকে সঙ্গী করে বিশ্ব চরাচর ঘুরি। একে একে দেখাই বিচিত্র সব আঙ্গিক। তিতাসই সব শিখিয়েছে। তিতাসকে ভোলা যায়?
তিতাসের জলে তৃষ্ণা মেটে। তিতাসের বুকে আশ্রয় মেলে। তিতাসের বাতাসে পরান জুড়ায়। তিতাস যেন জীবনের লেনাদেনা। তিতাসের তীরে খুঁজে ফিরি অদ্বৈতকে, খুঁজে যাই আল মাহমুদকে। খুঁজি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সুর-সংগীত। তিতাস কখনো আঞ্চলিক নয়। তিতাস জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক হয়ে যায়। তিতাসের সাদা-কালো ছবি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলে। আলোকচিত্রি ওবায়েদুল্লাহ মামুনের এক একটি ফটোগ্রাফ ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। তিতাস ছবি হয়, কবিতা হয়, গল্প হয়। উপন্যাস হয়েই তিতাস এত সমৃদ্ধ। ভিন্ন বাঁকে বলা যায়, তিতাস বলেই সে একটি উপন্যাস-আখ্যান।
তিতাসকে নানা নামে ডাকা যায়। যে নামেই ডাকি সে সভ্যতার সঙ্গী। তিতাস কখনো দুঃখ হয় না। তিতাস অনেক মানুষের জীবীকার আশ্রয়। তিতাস অনেক কিছুরই আশ্রয়। তিতাস বুক চিরে বয়ে চলে সময়-সভ্যতা। তিতাস একটি বৃহৎ অঞ্চলের অন্ন যোগানোর জন্য সহায়ক হয়। সবুজের সমারোহ হয়। কাল নিরবধি সে বয়ে চলে। যেন সে চিরকালীন সারথি।
তিতাসও মাঝে মাঝে কান্না করে। তার কান্না আমরা ধরতে পারি না। আবার সে নিজেও তার কান্না প্রকাশ করে না। তিতাসের গতিরেখা বদলে দেয় হায়েনারা। তিতাস শুকিয়ে যায়। তিতাস দখলেও যায়। তিতাসপ্রেমীরা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। তারা তিতাসকে বাঁচাতে পারে না। ব্যস্ত তাদের আর সময় হয় না। তিতাসের ওপর কালো থাবা আরো হিংস্র হয়। তিতাস তার যৌবন হারায়। তবু তিতাস মানুষের আশ্রয় হয়; প্রাণের শিহরণ হয়। তিতাস ভুলে না খাঁ সাহেবকে। ভুলে না অদ্বৈতকে। ভুলে না কানা মামুদকে। তাইতো তার তীরেই চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ে সোনালী কাবিনের কবি।
তিতাস ভুলে না কিছুই। তিতাসকে ভুলে যাই আমরা। বিখ্যাতবেলায় তিতাসের ডাকে সাড়া দিই না। সময় হয়ে উঠে না তিতাসের পরশে যাওয়ার। অথচ তিতাসেই আমাদের সমৃদ্ধি, তিতাসেই মুক্তি।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।