ছবি: সংগৃহীত
১৯ এপ্রিল, ১৮৮৪ সালে কাদম্বরী দেবী আফিম খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তার দুই দিন পর মাত্র ২৪ বছর বয়সে মারা যান। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার এ আত্মহত্যার বিষয়ে নীরব ছিল। গবেষকরা মনে করেন, স্বয়ং মহর্ষির উদ্যোগেই লোপাট করা হয় ‘সুইসাইড নোট’। কাদম্বরীর মৃত্যু সংবাদ তখন কোনো পত্রিকায় ছাপা হয়নি। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তার স্মৃতি নিয়ে মৃত্যুর দীর্ঘদিন পরেও একাধিক কবিতা, গান ও গল্প রচনা করেন।
মাতঙ্গিনী ছিল কাদম্বরী দেবীর পূর্বনাম। ঠাকুরবাড়িতে বউদের পূর্বনাম বদলে দেয়ার রেওয়াজ ছিল দীর্ঘদিনের। ধীরে ধীরে ‘মাতঙ্গিনী’ হারিয়ে গেল ‘কাদম্বরী’র মধ্যে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে কিছুটা গোঁড়া ও রক্ষণশীল ছিলেন। পরে দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ও বউদি জ্ঞানদানন্দিনীর প্রভাবে প্রাচীনপন্থি সংস্কার ত্যাগ করেন, হয়ে ওঠেন কলকাতার আধুনিক বাবু।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কাদম্বরীকে ঘোড়ায় চড়া শেখালেন। সে সময় কাদম্বরীর ঘোড়ায় চড়ে স্বামীর সঙ্গে হাওয়া খেতে বের হওয়া রীতিমতো আলোড়ন জাগিয়েছিল কলকাতার রক্ষণশীল সমাজে।
কাদম্বরীর মধ্যে ছিল এক চিরন্তন মাতৃহৃদয়। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করতেন। কারও জ্বর হলে শিয়রে কাদম্বরী, বাচ্চাদের কিছু সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন কাদম্বরী। রবি ঠাকুর ও তার নতুন বউঠানের সম্পর্ক ছিল স্নেহের-মায়ার। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের যা কিছু সুন্দর, তার সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন কাদম্বরী।
তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এসে তিনতলার ছাদে গড়ে তুললেন ‘নন্দন কানন’। পিল্পের উপর বসানো হলো সারি সারি পামগাছ। আশেপাশে চামেলী, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, করবী, দোলনচাঁপা ফুলের গাছ। তার সঙ্গে এলো হরেক রকম পাখি। ঘর সাজানোর দিকে প্রথম থেকেই কাদম্বরীর দৃষ্টি ছিল প্রখর। দেখতে দেখতে ঠাকুরবাড়ির চেহারা তিনি পাল্টে দিলেন।
ঠাকুরবাড়ির ছাদে কাদম্বরীর সাজানো বাগানে সন্ধ্যাবেলায় বসত গানের আসর। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাজাতেন বেহালা, রবীন্দ্রনাথ ধরতেন গান। কাদম্বরী নিজেও ভালো গায়িকা ছিলেন। বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ জগন্মোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের পৌত্রী তিনি, গান ছিল তার রক্তে। কাদম্বরী ঠাকুরবাড়ি আসার পর তিনতলায় এলো পিয়ানো। শুধু তাই নয়, কাদম্বরীর উত্সাহে ঠাকুরবাড়ির ছাদে বসত সাহিত্যপাঠের আসর।
কাদম্বরীর ছিল বইয়ের নেশা। তবে নিছক সময় কাটাবার জন্য তিনি বই পড়তেন না। বই পড়ে সেগুলোকে উপভোগ করতেন। ভাবতেন। তবে নিজে পড়ার চেয়ে শুনতে ভালোবাসতেন বেশি। দুপুরে রবীন্দ্রনাথ বই পড়ে শোনাতেন তার নতুন বউঠানকে, হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করতেন কাদম্বরী।
কাদম্বরী একজন ভালো অভিনেত্রীও ছিলেন। নাট্যরসিক জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মন আরও উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল কাদম্বরীর মতো গুণবতী স্ত্রীকে পেয়ে। একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে মাটির উঠোনে জ্যোতিরিন্দ্রের লেখা প্রহসন ‘এমন কর্ম আর করব না’-তে প্রথম অভিনয় করলেন কাদম্বরী। যে নাটকে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নায়কের ভূমিকায়। রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিলেতযাত্রার আগে এ প্রহসনটি সফলভাবে অভিনীত হয়। এরপরে ‘বসন্ত উত্সব’ এবং ‘মানময়ী’ নাটকেও কাদম্বরী বেশ ভালো অভিনয় করেন।
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই কাদম্বরীর অকালমৃত্যু হয়। ঘটনাটি ঘটে আকস্মিক। কারও মতে, কাদম্বরীর মৃত্যু আকস্মিক হতে পারে কিন্তু অপ্রত্যাশিত একেবারেই নয়। কারণ গবেষকদের মতে, ‘কাদম্বরী ছিলেন প্রচণ্ড ইন্ট্রোভার্ট, সেন্টিমেন্টাল’। একবার ছাদ থেকে প্রায় পড়তে পড়তে বেঁচে যান। আর বাঁচিয়েছিলেন রবি ঠাকুরই। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘কাদম্বরীর আকস্মিক মৃত্যুর কারণ হচ্ছে, মহিলাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের পরিণাম’। সম্ভবত জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গেই ছিল তার প্রবল মতান্তর।
ঠাকুরবাড়ির অনেকেই নানান কারণে কাদম্বরীকে অপমান করা শুরু করেছিল। খোঁটা দেয়া চলছিল নিয়মিত। কেউ কেউ মেনে নিতে পারেনি এক কর্মচারীর মেয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। ঠাকুরবাড়ির হিসেবের খাতা থেকে জানা যায়, কাদম্বরীর পিতা ছিলেন ঠাকুরবাড়ির এক সামান্য কর্মচারী এবং দাদু ছিলেন দারোয়ান!
কাদম্বরীর মতো সুরসিকা, রুচিশীলা, প্রতিভাময়ী নারীর জীবনে শান্তির অভাব ঘটতে থাকল। সন্তানহীনতার ব্যথা তার অভিমানকে আরও তীব্র করে তুলল। সেকালে বন্ধ্যা নারী ছিলেন সমাজে উপেক্ষার পাত্রী। সমাজে সংসারে কোথাও তার তেমন কোনো কদর ছিল না, কাদম্বরীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল। একাকিত্ব ভুলতে কাদম্বরী আফিম নেয়া শুরু করলেন। কাছের বলতে ছিলেন রবি। তিনিও বিয়ের পর নিজের স্ত্রীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
অন্যদিকে স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নাটক নিয়ে ব্যস্ত। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো দিন রাতে বাড়ি ফেরেন, নাহলে রাত কাটান থিয়েটারের লোকজনদের সঙ্গেই। স্বামীর সঙ্গে কথা প্রায় বন্ধ। কাদম্বরী আর সহ্য করতে পারছিলেন না। সেদিন কাদম্বরী দেরাজ থেকে শিশি খুলে নিয়মমাফিক আফিমের চেয়ে অনেক বেশি আফিমের গুলি খেলেন। আর উঠলেন না ঠাকুরবাড়ির আধুনিকা।
কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর কারণ যে তার স্বামীর অবহেলা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর পরিবারের অন্য নারীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক না-থাকাও একটা কারণ হতে পারে। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর জন্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর আত্মদগ্ধ হয়েছেন—সন্দেহ নেই। এজন্য মাত্র ৩৫ বছর বয়সে স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি সমাজ-সংসার ছেড়ে প্রায় সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করেছেন। স্ত্রী বেঁচে থাকতে অবহেলা করেছেন, কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাকে সারা জীবন আর ভোলেননি।
কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু নিয়ে অনেক কষ্টকল্পিত মুখরোচক কাহিনি লেখা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, তার মৃত্যু সম্বন্ধে আমরা কেবল অনুমান করতে পারি মাত্র।
আপন দেশ/এসএমএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।