ফাইল ছবি
‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’- পৃথিবীতে যুগে যুগে এই মহাসত্য কাল থেকে কালের গর্ভে ধ্বনিত হয়েছে। এই মহা সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বহু মানুষ বরণ করেছেন দুঃসহ যন্ত্রণাকে। ছেড়েছেন ঘর, খুঁজেছেন আপন দেহের ভেতরের ঘর। মানুষ থেমে থাকেনি। মানুষের কাছে মানবতার বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছেন।
পৃথিবীতে যত সাহিত্য রচিত হয়েছে, যত গান রচিত হয়েছে বা আজও হচ্ছে সেসব সাহিত্যের একটি বড় অংশে রয়েছে মানুষের জয়গান। মানুষের চেয়ে আর বড় কিছু হতে পারে না- এই মর্মবাণী মানুষের অন্তরকুটিরে ধ্বনিত হয়েছে বারবার। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই, কোনো উচু-নিচু জাত নেই, ধনী-গরীব নেই, ফর্সা বা কালো নেই সেসব বাদ দিয়ে রয়েছে কেবলই মানব প্রেম। মানুষের অধিকারের কথা, মানুষের হাতে মানুষের অবহেলা ইত্যাদি নিয়ে কবিতা, গল্প, উপন্যাস রচিত হয়েছে। এসব লেখক কবি বা গায়কের মধ্যে দু’জনের খুব মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যারা মানুষকে ভালোবেসেই কবিতা-গান রচনা করেছেন।
একজন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং অন্যজন ফকির লালন শাহ। দুই মহান সাধক (যারা মানবতার সাধনা করেছেন) যাদের জীবন দর্শনের একটি বৃহত্তর অংশ ছিল মানুষ। বস্তুত আমরা সাধারণ মানুষরা মানুষ শব্দটিকে যে অর্থে বা দৃষ্টিকোণে দেখি, বিচার করি, বা পার্থক্য করি তারা সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতেন না। ফকির লালন শাহ জন্মগ্রহণ করেন ১৭৭৪ সালের ১৭ অক্টোবর। তার দর্শনকে লালন দর্শন বলা হয়। আবার সুফিবাদও বলা হয়। তিনি খুঁজেছেন মনের মানুষ। বাইরে নয়, এই দেহের ভেতরের আমিত্বকেই তিনি দু’হাতে খুঁজেছেন। শেষ পর্যন্তও তার দেখা পাননি। তিনি ছুটেছেন পথ থেকে পথে।
‘আমি কোথায় পাব তারে/আমার মনের মানুষেরে’- কে সেই মনের মানুষ? মানুষের ভেতর যে মানুষ বাস করে, সে-ই তো মনের মানুষ। তার খোঁজ পায় ক’জনে। মানুষের খোঁজ পাওয়া কি এত সহজ! এবং অন্যজন মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম যিনি জন্মগ্রহণ করেন ২৫ মে, ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। দুই ভিন্ন শতকের অধিবাসী হয়েও দু’জনের কণ্ঠেই মানবতার জয়গান। যেখানে মানুষই বড়, মানুষই মহান। কাজী নজরুল ইসলাম আমরা যাকে বিদ্রোহী কবি হিসেবে চিনি বা জানি তিনি ছিলেন মূলত মানবতার কবি, ভেদ-অভেদের বিরুদ্ধে প্রজ্জ্বলিত মুর্তি, ধর্মের সংস্কার-কুসংস্কার পাশ কাটিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে আঁকড়ে ধরে বেঁচেছিলেন। তার লেখায়, গানে, সুরে পৃথিবীর মানুষকে জাগাতে চেয়েছেন। একটি সত্যিকারের জাগরণ আনতে চেয়েছেন। তার জীবনেও সেই ভেদ-অভেদের পার্থক্য দূর করার চেষ্টা করে গেছেন। মানুষকে ছোটো করা, মানুষের জাত-ধর্মভেদ দিয়ে বিচার করা, নিচুতাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেছেন। তিনি গেয়েছেন সাম্যের গান। কোনো সীমানা প্রাচীর, বর্ণ, গোত্র মানুষের থেকে মানুষকে আলাদা করতে পারে না। কবির মানুষ কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে সেই সুর। তিনি বলেছেন, গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান/ নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি/সব দেশে, সবকালে, ঘরে- ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
এ এক ধ্রুব মহাসত্য। মানুষ মানুষের জ্ঞাতি। হিংসা, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ক্রোধ-উন্মত্ততার উর্ধ্বে গিয়ে মানুষই তো মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু। আবার একইভাবে লালন শাহ জাত-পাত ঘৃণা করেছেন অন্তঃস্থল থেকে। তার কণ্ঠে উঠেছেÑ সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/লালন কয় জাতের কি রুপ দেখলাম না এই নজরে।। সুন্নত দিলে হয় মুসলমান/নারী লোকের কি হয় বিধান/বামন চিনি পৈতে প্রমাণ/বামনী চিনি কি করে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন, আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’ আসলে এ কথাটাই সত্য, লালন গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন তার সেই পরম মনের মানুষের কোনো জাত কোনো বর্ণ কোনো লিঙ্গ কোনো ধর্ম বলে কিছু নেই।
মানুষের ভেতর ঈশ্বরের বসবাস। এ সত্য উপলদ্ধি করেই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। জীবের অন্তরে ঈশ্বরের বাস। পৃথিবীতে মানুষকে বাদ দিয়ে কোনো শান্তির বার্তা মেলে না। কবি তার ঈশ্বর কবিতায় লিখেছেন, কে তুমি খুঁজিছ জগদীশ ভাই আকাশ পাতাল জুড়ে/কে তুমি ফিরিছ বনে-জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?/হায় ঋষি দরবেশ/বুকের মানিকে বুকে ধরে তুমি খোঁজ তারে দেশ দেশ/সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে/স্রষ্টারে খোঁজো-আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে। সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের জন্য মানুষের কাছে পৌছাতে হবে। আবার একইভাবে লালনের কণ্ঠে ফুটে উঠেছে- আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে/দেখ না রে মন ভেয়ে/দেশ দেশান্তর দৌড়ে এবার/মরছো কেন হাঁপিয়ে।।
আরও পড়ুন <> অমিয় চক্রবর্তীর বিখ্যাত চারটি কবিতা
মানুষের আত্মার খোঁজ করতে হবে। মানুষই হলো মানুষের সবচেয়ে বড় সাধনা। তবু মানুষই উপেক্ষিত হয়েছে যুগে যুগে। মানুষই হয়েছে হিংসার শিকার। মানুষের মাঝেই মেলে অমৃতের সন্ধান। সেই অমৃতের খোঁজ কতজন পায়? নজরুল-লালনের মতো কিছু মানুষ মানব জাতিকে সেই অমৃতের সন্ধান দেয়। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। প্রতিটি মানুষই সমান। এই দৃষ্টিকোণ প্রতিষ্ঠিত হলেও ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু, ফর্সা-কালো এরকম বহু পার্থক্য বিদ্যমান। পৃথিবীকে কলুষিত করছে এসব সংকীর্ণমনা দৃষ্টিভঙ্গি। কে সাহেব আর কে ভৃত্য তা-ই নিয়ে সমাজের শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। আমাদের জাতীয় কবি কিন্তু সেই ভেদাভেদে কোনোদিনও গা ভাসাননি। শ্লেষ-অশ্লেষের সাথে দ্বন্দ্ব তো চিরকালের। কবির অন্তর বরং এই পার্থক্যের কুলষ দেখে মর্মাহত হয়েছেন। কুলি-মজুর কবিতায় সেই অনুভূতিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কবিতার শেষ ক’টা লাইনে কবি বলেছেন, একজনে দিলে ব্যথা/সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা/একের অসম্মান/নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!/মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা উত্থান/উধের্ধ হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান।
আবার লালন তার গানে বলছেন, মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে/সেকি অন্য তত্ত্ব মানে।।/মাটির ঢিবি কাঠের ছবি/ভূত ভবিষ্যত দেবাদেবী/ ভোলে না সে এসব রুপী/মানুষ ভজে দিব্যজ্ঞানে।।
মানুষ লালন শাহর কাছে শ্রেষ্ঠ উপাসনা। মানব জনম তার কাছে শ্রেষ্ঠ জনম। তার দর্শনতত্ত্বের পুরোটা জুড়েই রয়েছে মানুষ তত্ত্ব। তাই তো তিনি গেয়েছেন, অনন্তরুপ সৃষ্টি করলেন সাই/শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই/দেব দেবতাগণ করে আরাধন/জন্ম নিতে এই মানবে। আজীবন ফকির জীবন যাপন করা ফকির লালন শাহ স্বপ্ন দেখতেন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র বা বিবেদহীন জীবন। তাই তো তিনি বলেছেন, এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে/যেদিন হিন্দু, মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান/জাতিগোত্র নাহি রবে। তার অন্তরে ছিল মানুষ। কাজী নজরুল ইসলামের গলায়ও ছিল মানুষের জয়গান। কবির সাম্যবাদী কবিতায় লিখেছেন, গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব/বাধা ব্যবধান/যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান/গাহি সাম্যের গান।
আবার কবির আশীর্বাদ কবিতায় বলেছেন, অনাত্মীয়রে আত্মীয় করো/তোমার বিরাট প্রাণ/করে না কো যেন কোনোদিন কোনো/মানুষে অসম্মান!।
মানুষে অসম্মানই জীবনের সবচেয়ে বড় পরাজয়। নিজের আত্নার অশুদ্ধি ঘটে মানুষকে ছোট করায়, মানুষকে তুচ্ছ করায়। তার এক জন্মেই যে দুই জীবন ছিল। মানুষের এই বিভেদ সৃষ্টি করা সমাজে তিনি ভালো মন্দ দুই চিত্রই উপলদ্ধি করেছেন। তাই তো সব ছেড়ে আকুণ্ঠ মানবসুধা পান করতে চেয়েছেন। মানুষ ভজলেই যে সোনার মানুষ হওয়া যায় এ তত্ত্বই মানব জাতিকে উপহার দিয়েছেন। তার সাধনার মূল মন্ত্র মানুষ। তার আরাধ্য ছিল মানুষ। হিন্দু, মুসলমান বা খ্রিস্টান ধর্ম নিয়ে /মাঝে মধ্যে যে বাড়াবাড়ি হয় তা থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। তাই খুঁজেনিয়েছিলেন মানুষকে। তিনি এক সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। মানুষ ও মানবতা নিয়ে ফকিল লালনের যে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তাভাবনা তা আজকের সমাজেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। ব্যস্ত সময়ে যখন মানুষ হাফিয়ে ওঠে হিংসা, হানাহানি, যুদ্ধ আর কৃত্রিমতায় তখন মানুষ লালনের, নজরুলের চিন্তাধারায় ফিরে যায়। মানুষকে সেখানে ফিরতেই হয়। কারণ শেষ পর্যন্ত তো আমরা মানুষই।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।