Apan Desh | আপন দেশ

নজরুলের গানে প্রেম-বিরহ

এস ডি সুব্রত

প্রকাশিত: ১১:২৬, ২৮ মে ২০২৪

নজরুলের গানে প্রেম-বিরহ

ফাইল ছবি

‘কেন আসিলে ভালোবাসিলে দিলে না ধরা জীবনে যদি।/বিশাল চোখে মিশায়ে মরু চাহিলে কেন গো বে-দরদি॥/... /ওগো কত নিরাশায় কত অভিমান ফেনায়ে ওঠে গভীর ব্যথায়।/মিলন হবে কোথায় সে কবে কাঁদিছে সাগর স্মরিয়া নদী॥’

এই গানে কবি নজরুল ব্যর্থ প্রেমের আঘাতে জর্জরিত অভিমানী প্রেমিকের আক্ষেপকে তুলে ধরেছেন, করুণ রসের ভাবাবেগে শ্রোতাকে প্রেমের আবেগে উতলা এবং অভিমানী।

নজরুল প্রেমের কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন প্রেমের গান। নজরুল ইসলাম একাধারে রচনা করেছেন গজল গান, কাব্য সংগীত, ঋতু-সংগীত, খেয়াল, গণসংগীত-শ্রমিক-কৃষকের গান, ধীবরের গান, ছাদপেটার গান, তরুণ বা ছাত্রদলের গান, মার্চ-সংগীত বা কুচকাওয়াজের গান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান, নারী জাগরণের গান, মুসলিম জাতির জাগরণের গান, শ্যামাসংগীত, কীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলী, অন্যান্য ভক্তিগীতি, ইসলামী সংগীত, শিশু সংগীত, নৃত্য-সংগীত, লোকগীতি...ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, সাম্পানের গান, ঝুমুর, সাঁওতালী, লাউনী, কাজরী, বাউল, মুর্শিদী এবং আরও নানা বর্ণের গান। বিভিন্ন বিদেশি সুরের আদলে রচিত গানের সংখ্যাও কম নয়।

এ ছাড়া লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় রাগ-রাগিণীকে অবলম্বন করে ‘হারামণি’ পর্যায়ের গান তিনি রচনা করেছেন। তিনি তার সৃজনশীল প্রতিভায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক  নতুন  রাগ সঙ্গীত রচনা করেছেন। তার রচিত নতুন রাগ রাগিণীর ওপর ভিত্তি করে লেখা ‘নবরাগ’ পর্যায়ের গানগুলো নজরুলের সাংগীতিক প্রতিভার অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয়বাহী। তার লেখা প্রেমের গানের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলো হলোÑ ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল’-, আলগা কর গো খোঁপার বাঁধন-, প্রিয় যাই যাই বলো না-, প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই, আজ নিশীথে অভিসার তোমার পথে, আমি সুন্দর নহি জানি, প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই, নিশি না পোহাতে যেয়ো না যেয়ো না, তব যাবার বেলা বলে যাও মনের কথা, আমি ময়নামতির শাড়ি দেবো, তোমার হাতের সোনা রাখি আমার হাতে, যাবার বেলায় ফেলে যেয়ো একটি খোঁপার ফুল, মিলন-রাতের মালা হব তোমার অলকে, ভালোবাসার ছলে আমায়, কে নিবি ফুল কে নিবি ফুল, পেয়ে আমি হারিয়েছি গো, সখি বাঁধো লো বাঁধো লো ঝুলনিয়া, এলে কি বধুঁ ফুল-ভবনে, বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে, যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, মোরা আর জনমে হংস-মিথুন, গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়, গভীর রাতে জাগি খুঁজি তোমারে, পরো পরো চৈতালী-সাঁঝে কুসমী শাড়ি, পিয়া পাপিয়া পিয়া বোলে, বুকে তোমায় যৌবন-সিন্ধু টলমল টলমল। এগুলো ছাড়াও তার লেখা অসংথ্য প্রেমের গানের কথা বলা যায়। তার গানে ফুটে উঠেছে প্রেম ও বিরহ। তার  গানে এ প্রেম নারীর প্রতি, স্রষ্টার প্রতি, প্রকৃতি ও সৌন্দর্যের প্রতি, স্বাধীনতা ও দেশের প্রতি; সর্বোপরি মানুষের প্রতি। তার অসংখ্য গানে এর ছাপ পাওয়া যায়। এই যেমন, ‘মোর প্রিয়া হবে, এসো রাণী, দেব খোঁপায় তারার ফুল’- নজরুলের এ গান যে কতটা রোমান্টিক, তা একমাত্র প্রেমিকযুগলই ভালো বলতে পারবেন।

নজরুল প্রেমের গান আবেগ-বৈচিত্র্যে ভরপুর।  বিষয় অনুসারে শব্দ নির্বাচনে, গজলে আরবি, ফার্সি ও উর্দু শব্দের ব্যবহার কীর্তন আঙ্গিকের গানে তৎসম সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য। রাগরূপের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় এত গভীর ছিল যে, তিনি অনায়াসে মিশ্রিত রাগে বা রাগ ভেঙে গান রচনা করতে পারতেন। এমনকি তার সৃষ্ট নতুন সুরের কবিত্বময় নামকরণও করেছিলেন। যেমন- নির্ঝরিণী, সন্ধ্যামালতী, বনকুন্তলা, দোলন চাঁপা, মীনাক্ষী। গানে গানে প্রেমের স্মৃতিচারণও করতেন নজরুল। ‘মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে বিদায় সন্ধ্যা বেলা, আমি দাঁড়ায়ে রহিনু এপারে, তুমি ওপারে ভাসালে ভেলা’।

প্রেমিক পুরুষ নজরুলের জীবনে প্রেম এসেছে বারবার। তাই তার বহু প্রেমের গানে বিরহের সুর লক্ষ্য করা যায়। প্রথম স্ত্রী নার্গিসের সঙ্গে বিচ্ছেদের সুদীর্ঘ ১৬ বছর পর নার্গিসের চিঠির উত্তরে লেখেন যে গান, সেটা এ যুগেও যেন প্রত্যেক ব্যর্থ প্রেমিকের হৃদয়ের গান। ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, কেন মনে রাখ তারে, ভুলে যাও তারে ভুলে যাও, একেবারে।’ নজরুলের প্রেমের গানগুলো  প্রেমের সঙ্গে বিরহ এবং আনন্দ বেদনার সমন্বয়ে রচিত। নজরুলের গান প্রেমের মধুরিমায় মুগ্ধ সকল শ্রোতা।  যেমন- ‘বঁধু মিটিল না সাধ ভালোবাসিয়া তোমায়, তাই আবার ভালোবাসিব ধরায়, মোর মনের প্রথম মুকুল, এসো প্রিয় মন রাঙায়ে, অঞ্জলী লহ মোর সংগীতে।’ এ গান আজও অনেকের মনে প্রেমের সাড়া জাগায়। রোমান্টিকতাযর সাথে বাস্তবতার সংমিশ্রণের কারণে বাংলা গান তার স্পর্শে হয়ে ওঠে আধুনিক। প্রেমকে তিনি অনুভব করেন কর্মের প্রেরণায় শোকের সান্ত্বনাতেও। তাইতো তিনি লিখতে পারেন এমন গান- ‘তুমি হাতখানি যবে রাখো মোর হাতের পরে, মোর কণ্ঠ হতে সুরের গঙ্গা ঝরে।’ সরলপ্রাণ নিবেদিত প্রেমিকের মত মিলনের  এক পরম আকাক্সক্ষা দেখা যায় তার গানে। যেমন- ‘মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম’, ‘তোমারেই আমি বাসিয়াছি ভালো শতরূপে শতবার’।

নারীর প্রতি নজরুলের ছিল পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। নজরুলের প্রেমের গানে নানাভাবে প্রাধান্য পেয়েছে নারীর প্রেম ভাবনা। ‘তুমি আরেকটি দিন থাকো’, ‘বঁধু আমি ছিনু বুঝি বৃন্দাবনের রাধিকার আঁখি জলে’, ‘ওগো রাণী, তোমার কাছে হার মানি আজি শেষে’- এসব গানে সেই চিত্রই ফুটে ওঠে।

নজরুলের অসংখ্য কবিতা ও গানে প্রেম ও বিরহ প্রকাশ পেয়েছে। হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে কবি একা ঝরাফুল কুড়িয়ে গেছেন। প্রেমিক কবি নজরুলের গান ও কবিতা আজকের প্রেমিক প্রেমিকাদের হৃদয়তন্ত্রীকে প্রেম ভালোবাসা এবং বিরহ বেদনায় অনুরণন ঘটায়। নজরুল ঐতিহাসিক প্রেমের গানেও  ছিলেন সিদ্ধহস্ত। যেমন- লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, শাহাজাহান-মমতাজ, সেলিম-নুরজাহানকে নিয়ে লেখা গান। বিস্ময়কর প্রেমিক ছিলেন নজরুল। ভালোবাসার উচ্ছ্বাস নিয়ে প্রেমিকার দিকে তাকিয়ে তারই বলা সাজে, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি, সে কি মোর অপরাধ?’

প্রেমের সাতকাহনের হিসাব-নিকাশ মেলেনি। তাই বলে থেমে থাকতে হবে? কোনো না কোনোভাবে প্রেমিকার সঙ্গে থাকার ব্যাকুলতা নিয়েই বলেছেন, ‘আমায় নহে গো ভালোবাস শুধু ভালোবাস মোর গান। বনের পাখিরে কে চিনে রাখে গান হলে অবসান।’ আনন্দ, বিরহের পাশে থাকত বিস্ময়ও। যৌবনের সেরা সময়ে প্রেমিকার দেখা পাননি। বেলা বয়ে যাওয়ার পর সেই সাক্ষাতে বললেন, ‘পরান-প্রিয়! কেন এলে অবেলায় শীতল হিমেল বায়ে ফুল ঝরে যায়।’ আহা আক্ষেপ করাতে ছিল একটা সুরের ছন্দ। অজানা কষ্টকে ধারণ করার তীব্র ক্ষমতা। বিরহ জানাতে হৃদয় খুঁড়ে বেরিয়ে আসত ভিতরের সব আকুলতা। সুরের ঝংকারে ঝরতো না বলা কথার বেদনা। নজরুল বুঝতেন, যে কথা বলা হয়নি তাও বলতে হবে। তাই তো তিনি লিখলেন, ‘কত কথা ছিল বলিবার, বলা হলো না। বুকে পাষাণসম রহিল তারই বেদনা। মনে রহিল মনের আশা, মিটিল না প্রাণের পিপাসা।’

আপন দেশ/এমআর

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়