ড. শাহাদাৎ হোসেন নিপু ও বাংলা অ্যাকাডেমি ভবন। ছবি: সংগৃহীত
ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন ঘটেছে। কিন্তু বাঙালির মেধা ও মণনের প্রতিষ্ঠান বাংলা অ্যাকাডেমিতে এখনো সক্রিয় ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারের দোসররা। তাদের ইচ্ছামতোই চলছে বাংলা অ্যাকাডেমির সকল কার্যক্রম। ৫ আগস্টের পর বাংলা অ্যাকাডেমিতে দাপট আরও বেড়েছে।
নতুন মহাপরিচালক যোগদানের পর থেকেই পতিতের দোসর কর্মকর্তারা মহাপরিচালককে নিজেদের মতো করে পরিচালনা করছেন। এমন তথ্য জানিয়েছে বাংলা অ্যাকাডেমির অভ্যন্তরের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র। এ নিয়ে অ্যাকাডেমির অভ্যন্তরে ক্ষোভে পুষছেন কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা।
সূত্রটি জানায়, অন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলা অ্যাকাডেমিতে নতুন মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। তিনি যোগদানের পর থেকেই ফ্যাসিবাদী আওয়ামীলীগের কর্মকর্তারা তাকে সবসময় ঘিরে রাখেন। অ্যাকাডেমি কিভাবে পরিচালনা করবে সে বিষয়ে কূটপরামর্শ দিয়ে আসছেন। এর ফল স্বরূপ মহাপরিচালক প্রশাসন, মানবসম্পদ ও পরিকল্পনা বিভাগের সমীর কুমার সরকার নামে পতিতের দোসরকে বদলি করেন। একইসঙ্গে প্রশাসন উপবিভাগেও আওয়ামী ঘরনার উপপরিচালক ইমরুল ইউসুফকে পদায়ন করা হয়। ফলে বাংলা অ্যাকাডেমি এখন ফ্যাসিবাদী কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে। সাধারণ কর্মকর্তাদের যে বিভাগে কাজ নেই, প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না সে বিভাগে বদলি করা হয়েছে। এ নিয়ে মহাপরিচালক ও সচিবকে সাধারণ কর্মকর্তারা অভিযোগ করলেও তারা কোনো কিছু আমলে নেননি।
বাংলা অ্যাকাডেমিতে ফ্যাসিবাদিদের দাপটের বড় প্রমাণ হচ্ছে ১৭ অক্টোবর আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের স্মরণানুষ্ঠানে অ্যাকাডেমির অভ্যন্তরে মন্দ মানুষখ্যাত স্বৈরাচারের দোসর গবেষণা উপবিভাগের উপপরিচালক ড. সাইমন জাকারিয়াকে আলোচকের চেয়ারে স্থান দেয়া। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া স্বৈরাচারের এ দোসরকে আলোচক হিসেবে মনোনীত করে পোস্টার ফেইসবুকে পোস্ট করার পর লেখক সাহিত্যিকরা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। যার কারণে মহাপরিচালক বাধ্য হয়ে ড. সাইমন জাকারিয়াকে অনুষ্ঠানের আলোচক থেকে বাদ দিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন।
অপরদিকে আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ও আজ্ঞাবহরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বাংলা অ্যাকাডেমি। ফ্যাসীবাদী আওয়ামী লীগের এসব কর্মকর্তাদের কারণে ধীরে ধীরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠান।
অ্যাকাডেমির আরেক কর্মকর্তা ড. মোঃ শাহাদাৎ হোসেন নিপুর বিরুদ্ধে রয়েছে আওয়ামী আমলের রাজনৈতিক প্রভাবসহ দুর্নীতির একগুচ্ছ অভিযোগ।
সূত্র জানায়, ড. নিপু তার সরকারের আমলে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে প্রথমে বাংলা অ্যাকাডেমিতে সহপরিচালক (চুক্তিভিত্তিক) নিয়োগ নেন। পরে অবৈধভাবে সরাসরি উপপরিচালক পদে নিয়োগ দানে বাধ্য করেন। এটি বাংলা অ্যাকাডেমির প্রবিধানমালার পরিপস্থী।
আরও জানা যায়, তিনি আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি বিষয়ক উপকমিটি (২০১৯-২০২১) সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানেও উক্ত কমিটির তিনি সক্রিয় সদস্য। যা বাংলা অ্যাকাডেমির কর্মচারি চাকরির প্রবিধানমালার ৪১(১) ধারার পরিপন্থী। ওই ধারায় উল্লেখ আছে, ‘কোনো কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গ সংগঠনের সদস্য হইতে অথবা অন্য কোনোভাবে উহার সহিত যুক্ত হইতে পারিবে না। অথবা বাংলাদেশে বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করিতে বা কোনো প্রকার সহায়তা করিতে পারিবে না।’ অথচ তিনি প্রতিনিয়ত দম্ভের সঙ্গে উপকমিটির পরিচয় ব্যবহার করে অফিসে ও অফিসের বাইরে প্রভাব বিস্তার করে বিভিন্ন রকমের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন।
তিনি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়মিত অংশগ্রহণ, আবৃত্তি ও উপস্থাপনা করেন বলে জানা যায়। বিগত সরকারের আমলে তিনি রাজনৈতিক পরিচয় ও দলীয় লোকজনদের ব্যবহার করে অ্যাকাডেমিতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে ।
এছাড়াও রাজনৈতিক ও পেশীশক্তির প্রভাব খাটিয়ে অমর একুশে বইমেলায় বইয়ের স্টল, খাবারের দোকান নিজ ও তার স্ত্রীর নামে বরাদ্দ নিয়ে কয়েক বছর ধরে অবৈধভাবে ব্যবসা করে আসছেন। বিগত ২০২৩ ও ২০২৪ সালের বইমেলায় নিপু তার স্ত্রীর ‘নড়াইল পিঠাঘর’ নামে দুইটি খাবারের দোকান ভাড়া না দিয়ে জোরপূর্বক দখল করে ব্যবসা পরিচালনা করেন। তার বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে স্টল বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রেও অনেককে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও নিপুর বিরুদ্ধে অধিনস্ত কর্মচারীদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন এবং অর্থের বিনিময়ে নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে, অ্যাকাডেমির তথ্যপ্রযুক্তি উপবিভাগে সহপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মোছাম্মৎ সাবিনা ইয়াসমিন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপকমিটির (২০২২-২৪) সক্রিয় সদস্য। এক্ষেত্রে তিনি সচেতনভাবে তার নাম কমিটিতে পরিবর্তন করে অ্যাকাডেমির সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। তবে কমিটির তালিকা ও বাংলা অ্যাকাডেমির ওয়েবসাইটে তার মোবাইল নম্বার একই হওয়ায় এটা নিশ্চিত যে, সাবিনা ইয়ামিন ও সাবিনা আক্তার একই ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডার, কেনাকাটাসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতর সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, রাজনৈতিক জোর খাটিয়ে প্রথমে তার স্বজনদের চুক্তিভিত্তিক ও পরে স্থায়ী চাকরি পাওয়ার ব্যবস্থা করেন। তার বিরুদ্ধেও অধিনস্ত কর্মচারীদের মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। বাংলা অ্যাকাডেমিতে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এসব কর্মকর্তার আচরণ ও অনিয়মের কাছে সাধারণ কর্মকর্তরা অসহায় বোধ করছে।
এ বিষয়ে বাংলা অ্যাকাডেমির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবহিত হয়েও আওয়ামী লীগের প্রভাবের কারণে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন নি।
বিষয়গুলো জানার জন্য অ্যাকাডেমির মহাপরিচালককে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
আপন দেশ/এবি
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।