Apan Desh | আপন দেশ

নীলক্ষেত বই বাজারের কথা

দীপংকর গৌতম

প্রকাশিত: ১৯:১৬, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫

নীলক্ষেত বই বাজারের কথা

ছবি: ইন্টারনেট

নীলক্ষেতের বইয়ের বাজার নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। থরে থরে সাজানো বই নিয়ে কেউ বসে আছে ফুটপাতে, কেউ নীলক্ষেত মার্কেটের দোকানে। বই ফুটপাতে সাজিয়ে দোকানি বলছেন, ‘যেটা লয়ন ১০ টাকা’। বই ব্যবসার সঙ্গে এখানেই বোধ করি সবচেয়ে বেশি মানুষ জড়িত।  কম টাকায় বই কেনার এমন জায়গা আর কটা আছে? 

নীলক্ষেতের ইতিহাস অনেক পুরোনো। ১৮৪৭ সালের দিকে ঢাকায় ৩৭টি নীলকুঠি ছিল। বর্তমান নীলক্ষেত নামে যে এলাকাকে চিনি, এখানে কোনো জনবসতি ছিল না। তবে ধারণা করা হয়, সেই নীলকুঠির নীল থেকেই নীলক্ষেতের নামকরণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, বুয়েট, ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বই-খাতার বাজার হিসেবে নীলক্ষেত বই বাজারের গোড়াপত্তন ঘটে। 

যতদূর জানা যায়, ১৯৬৬ সাল থেকে নীলক্ষেত এলাকায় পাঠ্য বইয়ের বাজার শুরু হয়। সত্তরের দশকে নীলক্ষেতে দুষ্প্রাপ্য সব বই পাওয়া যেত বলে একাধিক প্রবীণ জানিয়েছেন। তবে কম দামে বই পাওয়ার ইতিহাসও অনেক পুরোনো। মিরপুর, পুরানা পল্টন ও বাংলাবাজারে কম দামে বই পাওয়া গেলেও নীলক্ষেতের বিষয়টি আলাদা। তবে যুগের চাহিদা আর পাঠকের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় নীলক্ষেতের অনেক কিছুই বদলেছে। 

এর ছোট ছোট গলির ভেতরে কত সব ব্যবসা রয়েছে তা ভেবে কূলকিনারা হবে না। মাহবুব নামের একজন ব্যবসায়ী হাসতে হাসতে বললেন, এখানে এমন সব কারিগর আছেন, যাঁরা অক্সফোর্ডের সার্টিফিকেট থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইয়ের অরিজিনালটা তৈরি করে দিতে পারে। 

নীলক্ষেতের মোড়েই দেখা হয় বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের এক শিক্ষার্থী সুমনের সঙ্গে। তিনি ডাটা স্ট্রাকচার এবং অবজেক্ট অরিয়েন্টেড প্রগ্রামিং বিষয়ে দুটি বই কিনেছেন। বললাম, ‘পাইরেট কপি?’ তিনি নির্দ্বিধায় বললেন, ‘হ্যাঁ’। ‘পাইরেটেড কপি নিতে খারাপ লাগে না?’ তিনি খুব সহজেই বললেন, ‘কেন লাগবে? আমি এত কম টাকায় না পেলে তো কিনতেই পারতাম না।’

আসলেই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব বইয়ের যে দাম তাতে সব বইয়ের মূল কপি কিনে পড়া সবার পক্ষে সম্ভব নয়। পাইরেসি কিভাবে করে জানতে চাই ব্যবসায়ীদের কাছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, এখানে পাইরেসি হয় কয়েক ধরনের- ১. চিকিৎসাবিদ্যা, প্রকৌশলসহ বিভিন্ন ক্লাসের বই; ২. লেখকদের উপন্যাস, গল্প (কাটতি আছে যেগুলোর); ৩. অর্ডারের (দুর্লভ কোনো বই, সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া গেল না, পিডিএফ থেকে নামিয়ে প্রিন্ট করে দেয়া হয়।) আগে নতুন বই ফটোকপি ও বাঁধাই করে কালার প্রিন্টারে প্রচ্ছদ ছেপে তারপর বাজারে নেয়া হতো। তবে সেসব বইয়ের ছাপার মান, কাগজ ভালো না। এখন অনলাইনে বিভিন্ন বইয়ের পিডিএফ আছে। সেটা কম্পিউটারে ডাউনলোড করে প্রিন্ট দেয়া হয়। এরপর বাঁধাই করে ৯০ গ্রাম অফসেটে বাইন্ডিং করে বাজারে পাঠানো হয়। বর্তমানে পিডিএফ থেকে বই ছাপানোর কাজ বিভিন্ন অনলাইন বইয়ের দোকানও পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করেছে। পাঠকের চাহিদার কথা মাথায় রেখেই কাজটি শুরু হয়েছে। 

নীলক্ষেতে খুঁজলে এমন বই নেই যা পাওয়া যাবে না- এমন ধারণাই সবার। তবে এ ব্যাপারে বড় তথ্যটি হলো জনপ্রিয় ও পরিচিত বই ছাড়া এখানে সহজে পাওয়া যায় না। আলম নামের একজন বইয়ের হকার কথা প্রসঙ্গে জানালেন, বই ছাপাতে অনেক টাকা খরচ হয়। ভালো বই না হলে সবাই কিনে না। তাই যেসব বই বেশি বিক্রি হয়, সেগুলোই এখানে বেশি পাওয়া যায়। ফুটপাতের রাশি রাশি বইয়ের দিকে একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে- ইট অ্যান্ডস উইদ আস, ইট স্টার্টস উইদ আস, ফিফটি শেডস অব লাভ ঘরানার রোমান্টিক বই বেশি। পাশাপাশি রয়েছে মোটিভেশনাল বইয়ের ছড়াছড়ি। ক্লাসিক ঘরানার কিছু বইও নীলক্ষেতে দেখা যায়, সেগুলোও বহুল আলোচিত।

এখন প্রযুক্তির কল্যাণে নতুন নতুন পদ্ধতি এসেছে। বই পাইরেসির এসেছে নতুন নিয়ম। এই নিয়মের নাম পিডিএফ কপি। পিডিএফ বই অনলাইন থেকে ডাউনলোড করে ছাপানোর বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানের নাম গাউসুল আজম মার্কেট। নিউ মার্কেট থানা থেকে কিছুদূর এগোলে গাউসুল আজম মার্কেট। সেখানে রয়েছে প্রিন্টিং ও বাঁধাইয়ের আরেক সাম্রাজ্য। বহু দোকানে এ কাজ চলছে। সেখানে পিডিএফ বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোকে ফটোকপি করা হয়, এরপর বাঁধাই আর মলাটের কাজ। এভাবে বই করে নিতে খরচ কম। পাইরেসি আইনত অপরাধ। কিন্তু পাঠকের সামর্থ্যরে কথার সঙ্গে ভাবলে বিষয়টি ভাবা সহজ হবে। নীলক্ষেতের কল্যাণে শিক্ষার্থীরা কম টাকায় বই কিনতে পারছে। সম্প্রতি অরুন্ধতী রায়কে বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার বই পাইরেসি হচ্ছে, এ ব্যাপারে মন্তব্য কী? উত্তরে তিনি বলেছেন, হোক, মানুষ আমার বই পড়ছে- এটাই বড় কথা।

আপন দেশ/এসএমএস

মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়