কবি আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯)
কবি আল মাহমুদের পুরো নাম মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ। সাহিত্য জগতে আল মাহমুদ নামে পরিচিত। আল মাহমুদের ডাক নাম ছিল পিয়ারু। কবি আল মাহমুদের পূর্ব পুরুষগণ ইসলাম প্রচারক দলের সাথে বাংলাদেশে আসেন ফিরোজ শাহের সিলেট ও উত্তর কুমিল্লা দখলেরও দুইশত বছর পর। কাইতলার মীরদের একটি শাখায় জন্ম কবি আল মাহমুদের। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল মোল্লা বাড়িতে কবি আল মাহমুদের জন্ম। বাবার নাম মীর আব্দুর রব এবং মায়ের নাম রওশন আরা মীর। আল মাহমুদের দাদা মীর আব্দুল ওহাব ছিলেন কবি যিনি আরবি ফারসি ভাষায় পন্ডিত। লিখতেন জারি গান। আল মাহমুদের মা ছিলেন সিলেট শায়েস্তাগঞ্জ এলাকার এক জোরদারের মেয়ে। দাদীর পান খাওয়া লাল ঠোঁট আর তার মুখ নিঃসৃত অনন্য সব রূপকথা শুনে শুনে বড় হয়েছেন কবি আল মাহমুদ।
ছোটবেলায় তাকে কোন বাড়ির ছেলে বললেই, তিনি মোল্লা বাড়ির সুন্দর উঁচু ঘর দেখিয়ে বলতেন ওটাইতো আমাদের বাড়ি। কবির যাযাবরি ভগ্নি এবং শিক্ষয়েত্রী ছিলেন আলকি। আলকির কাছে কবি এক মানবীয় প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলেন। ছোটবেলায় মহরমের মাস কবির মনে দাগ কাটত। বাড়ির মেয়েরা আশুরার সময় মর্সিয়া গাইয়েদের এনে শোকগাথা শুনত সবাই। নাগারচির বাজনা আর আর হ্যাজাকের আলোয় রাতে লাঠি খেলা হতো কবির বাড়িতে মহরমের মাসে। বাড়ি থেকে কোয়াটার মাইল দূরে তিতাস নদীতে স্নান আর সাঁতার কেটে বড় হয়েছেন কবি আল মাহমুদ। জন্ম ১১.০৭.১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ এবং মৃত্যু ১৫.০২.২০১৯ খ্রিস্টাব্দে। মোল্লা বাড়ির পিয়ারু যখন সকালে ঘুম থেকে উঠত, সঙ্গীতের শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘরে ঘরে ছোট ছেলেমেয়েদের সুর সাধার শব্দ শুনে মুগ্ধ হতেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে জন্ম নিলেও ঢাকাকেই নিজ শহর হিসেবে বেশি ভাবতেন পিয়ারু। কবির ভাষায়Ñ ‘যে শহর জন্ম দেয়, জীবিকা দিতে পারে না, সে শহর থেকে জীবিকাদাত্রী শহরকেই মাতৃতুল্য আপন নগরী মনে করি আমি। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মে শুধু কৈশোরকাল কাটিয়েছি। কিন্তু ঢাকা আমাকে দিয়েছে যৌবনের বিস্ময়, প্রেম, খ্যাতি ও কবিতা। দিয়েছে সাহিত্যিক ঈর্ষা এবং কথা বলার অধিকার।’ গদ্যপাঠে শফি স্যারের স্পষ্ট ও সুন্দর উপমা পরবর্তীতে কবির সাহিত্যজীবনে কাজে লেগেছিল বেশ। কবির প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এমই স্কুলে। অঙ্কের প্রতি ছিল তার অবহেলা। এর জন্য কবির আফসোস ছিল। স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিন থেকেই কবি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি মুসলমান হওয়ার কারণে সংখ্যাগুরু সহপাঠীদের অবহেলার পাত্র। ফলে প্রায়ই মাথা ফাটাফটির মতো ঘটনা ঘটত।
কবি তার আত্মজীবনী ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ গ্রন্থে আরো লিখেছেন, এমই স্কুলে মুসলমানদের নেতা ছিলেন বাহাদুর হোসেন খাঁ যিনি এ উপমহাদেশের বিখ্যাত সরোদ বাদক হয়েছিলেন। আল মাহমুদের ভাষায়- ‘হিন্দু ছেলেরা বাহাদুর হোসেন খা’র নাম বিকৃত করে বাদুইরা বলে ডাকত। স্কুলে ঠিকমতো গেলেও গুলতি দিয়ে পাখি শিকারের নেশা ছিল আল মাহমুদের। রোমাঞ্চকর বই পড়ার অভ্যাস ছিল তার নেশার মতো। কিশোর বয়সে তিনি শুনেছিলেন ভাষাই মানব সন্তানের ব্যক্ত হওয়ার একমাত্র উপায়। সে সময় কবি বইয়ের দোকান আর সাধারণ গ্রন্থাগারে যাতায়াত করতে লাগলেন। এক সময় কবি বাজে বই ছেড়ে গল্পের বই পড়তে শুরু করলেন। আল মাহমুদ তার ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ গ্রন্থে লিখেছেনÑ আমার অসম্ভব বই পড়ার অভ্যাস দেখে আব্বা আম্মা চিন্তিত হতে লাগলেন বয়ঃসন্ধিকালে। কবি যখন একা থাকতেন তখন সহানুভূতি জানাতে তার পাশে দাঁড়াত কবির যুবতী ফুফাতো বোন সাদেকা , কবি যাকে সাদু বুবু বলে ডাকত। আদরে আর ভালবাসার আবেগ আতিশয্যে সাদেকার বিয়ে ঠিক হলে একদিন কবি তাঁকে বলেছিলেন- ‘সাদু বুবু আমিই তোমাকে বিয়ে করব’। সাদু বুবুও সেদিন তাকে বলেছিলÑ ‘আমকে এত ভালবাসিস যদি তবে আমার ছোট হয়ে জন্মালি কেন?’ বই খুঁজতে খুঁজতে কবির সাথে যেসব মানুষের পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়েছিল তারা ছিল তার অসমবয়সী। এ তালিকায় ছিল স্কুলের মাস্টার, কেরানি, বড় ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মচারীর মেদবহুল স্বাস্থ্যবান স্ত্রী, বিধবা নারী যার স্বামী ছিল স্বরাজ আন্দোলনের নেতা। ওই বিধবা মহিলা ও তার বোন শোভার সাথে রেলস্টেশনে দেখা ও তাদের বাড়িতে নিয়ে আসা। ভদ্র মহিলা ছিলেন হিন্দু বৈদ্য যিনি আল মাহমুদের বিস্ময়কর বইয়ের পুলকিত দরজা খুলে দিয়েছিলেন। দেশি-বিদেশি অগণিত বইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এই মহিলা। ওই মহিলার বাড়িতে ছিল অনন্য সব বইয়ের সমাহার। ওই ভদ্র মহিলা পিয়ারুর মায়ের কাছে তার প্রসংশা করে বলেছিলেন-‘জ্ঞানে যারা তৃপ্তি পায়, তাদের নাকি ক্ষুধা তৃষ্ণা থাকে না, আমার স্বামী বলতেন।’ কবি ও বিধবা মহিলা ও তার বোন শোভাকে তাদের বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়ে তাদের বাড়িতে থেকেছিল। শোভার সাথে কবির একসময় ভাব হয়ে যায়। তারপর কবি কত চাঁদনি রাতে শোবার সাথে কুরুলিয়া ব্রিজে দাঁড়িয়ে থেকেছিল তা দেখে লোকে নানা ভাবনা ভাবতো। কবি নিজেই বলেছেন, শোভার কাছ থেকে পালিয়েও থাকতে পারিনি। তা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এর কারণ প্রেম কিনা জানি না। শোভাদের বাড়ি থেকে লালমোহন পাঠাগারের ঠিকানা পেয়েছিলেন কবি। শোভা তাকে ‘ইতিহাসের ধারা’ ও শোভার দিদি ‘রাইকমল’ বই উপহার দিয়েছিল।
এরপর থেকে কবি নিয়মিত লালমোহন পাঠাগারে যাতায়াত করতেন। সেখানে পরিচয় হয় কানুদার সাথে। এন্ডারসন ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে কবি ভাবতেন শোভার চেয়ে সুন্দরী মেয়ে পৃথিবীতে নেই। লালমোহন পাঠাগারে যাতায়াতের সুবাধে কবি মার্কসীয় চিন্তাধারায় আকৃষ্ট হন। তখন কবির আচরন বদলে যেতে থাকে। আল্লাহর ভয় বুক থেকে পালাতে লাগল। কবি তার আসল প্রচারক পূর্বপুরুষের কথা ভুলে যেতে লাগলেন। একবার কবির খ্রিস্টান বন্ধু শিশির সিংহ তার কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকে জীবনানন্দ দাশের ‘মহাপৃথিবী’ বইটি উপহার দিয়েছিল। মহাজীবন গ্রন্থের কবিতা পড়ে বিশাল উত্তেজনায় কেপেছিল কবির শরীর। শুরু করলেন কবিতা লেখা। শুরু করলেন নতুন জীবন। শব্দের গন্ধ টের পেলেন তখন আল মাহমুদ।
কবির প্রথম কবিতার শ্রোতা ছিলেন কবির চাচাত বোন হানু। হানুরও পড়ার অভ্যাস ছিল ভীষণ। সেই সময় কবির লেখার পর প্রথম হানুকে পড়তে দিতো কবি। সাধু তার লেখার প্রশংসা করত। বিখ্যাত কবি ও লেখক মাহফুজ উল্লাহর কাছ থেকে ছন্দ ও তাল সম্পর্কে প্রথম ধারণা পেয়েছিলেন। তিনি আল মাহমুদকে ছন্দের সাধারণ নিয়মগুলো ধরিয়ে দিয়েছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনের ঢেউ লেগেছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তখন আল মাহমুদ তাজুল ও মুহম্মদ মুসার সাথে যোগ দিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনে। সেই সময়ে ভাষা আন্দোলনের লিফলেটে কবির অজান্তেই কবির কবিতার চার লাইন ছেপে দেওয়া হয়েছিল। তখন আল মাহমুদ রাস্তায় ও ট্রেনে ভাষা কমিটির জন্য চাঁদা তুলতে বক্তৃতা ও যুক্তি দিতেন। একবার কবি তেলিয়াপাড়ায় ফুফুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে এক চা শ্রমিকের দুঃখগাথা শুনে বলেছিলেন- ‘কবিদের কাজও কুলিদের মতো । উভয়েই চায় খারাপ জিনিস থেকে বেছে যা কিছু কচি ও কোমল তা আলাদা করে ফেলতে। কুলিরা কচি পাতা বাছে, আমরা কোমল শব্দ বাছি।’
আপন দেশ/আরএ
মন্তব্য করুন # খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।