Apan Desh | আপন দেশ

পোশাক রফতানির আড়ালে ৩০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার, ১০ প্রতিষ্ঠান শনাক্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৩:৩৯, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

পোশাক রফতানির আড়ালে ৩০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার, ১০ প্রতিষ্ঠান শনাক্ত

ফাইল ছবি

তৈরি পোশাক রফতানির আড়ালে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে বলে জানিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। একইসঙ্গে পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১০টি প্রতিষ্ঠানকে শনাক্তও করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) শুল্ক গোয়েন্দার যুগ্ম পরিচালক মো. শাসমুল আরেফিন খান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

শনাক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- সাভারের প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড, গাজীপুরের পিক্সি নিট ওয়্যারস ও হংকং ফ্যাশনস লিমিটেড, ঢাকার ফ্যাশন ট্রেড, এম ডি এস ফ্যাশন, থ্রি স্ট্রার ট্রেডিং, ফরচুন ফ্যাশন, অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড, স্টাইলজ বিডি লিমিটেড ও ইডেন স্টাইল টেক্স।

জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি পোশাক পণ্যের চালান বিদেশে রফতানি হচ্ছে, এ কারণে পণ্যমূল্য বা বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবাসিত হচ্ছে না- এমন অভিযোগের ভিত্তিতে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর কাজ শুরু করে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিল অব এক্সপোর্ট ঘেটে সংস্থাটি জানতে পারে, তারা জালিয়াতি করে অন্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার করে পণ্য রফতানি করেছে এবং বিল অব এক্সপোর্টের ২৪ নম্বর কলামে নমুনার কোড ২০ ব্যবহার করছে। এক্ষেত্রে কোনো অর্থ দেশে প্রত্যাবাসিত না হয়ে পুরো রফতানি মূল্য বাবদ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে।

তদন্তকালে ১০টি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে এক হাজার ২৩৪টি পণ্যচালানে এমন জালিয়াতি করেছে। রফতানি সম্পন্ন হওয়া এসব চালানের বিপরীতে পণ্যের পরিমাণ নয় হাজার ১২১ মেট্রিক টন, যার প্রত্যাবাসনযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রার সম্ভাব্য পরিমাণতিন কোটি ৫৩ লাখ ৬৬ হাজার ৯১৮ মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।

প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্ট দলিলাদি পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানসমূহ টি-শার্ট, টপস, লেডিস ড্রেস, ট্রাউজার, বেবি সেট, পোলো শার্ট প্রভৃতি পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব ও নাইজেরিয়া প্রভৃতি দেশে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রফতানি দেখিয়ে অর্থপাচার করেছে।

ওই ১০টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মূলত বিল অব এক্সপোর্টে ন্যাচার অব ট্রানজেকশনের কোড ২০ ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার করেছে।

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর সূত্রে আরও জানা গেছে, ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিল অব এক্সপোর্টসমূহ পর্যালোচনায় বিল অব এক্সপোর্ট ও ইএক্সপিতে বর্ণিত তথ্যের মধ্যে মিল পাওয়া যায়নি। বিল অব এক্সপোর্টে উল্লিখিত সাউথ ইস্ট ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ওই ১০ প্রতিষ্ঠানের কোনোটিই ওই ব্যাংকে লিয়েনকৃত নয়।

এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সঙ্গে ওই ব্যাংক সম্পর্কিত নয়। ফলে ব্যাংকটির মাধ্যমে বিল অব এক্সপোর্টে উল্লিখিত সেলস কন্ট্রাক্ট বা ইএক্সপির রফতানিমূল্য প্রত্যাবাসিত হয়নি বা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

কাস্টমস গোয়েন্দারা জানান, প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড ২০১৯ সালে ৩৮৩টি এবং ২০২০ সালে আটটিসহ ৩৯১টি রফতানি চালানের মাধ্যমে অর্থপাচার করেছে। রফতানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে তিন হাজার ৮০ মেট্রিক টন টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পাজামা প্রভৃতি পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রফতাপ্তানি করা হয়েছে।

আলোচ্য পণ্যচালানগুলোতে রফতানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় এক কোটি আট লাখ ৪১ হাজার ৬৯৯ মার্কিন ডলার বা ৯২ কোটি চার লাখ ৬০ হাজার ২৪৫ টাকা প্রায়। এ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি সিএন্ডএফ এজেন্ট।

ফ্যাশন ট্রেড ২০২০ সালে ৭৩টি, ২০১৯ সালে ১১৬টি, ২০১৮ সালে ৫৭টিসহ ২৪৬টি রফতানি চালানে জালিয়াতি করেছে। রফতানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে এক হাজার ৭৭৯ মেট্রিক টন টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পাজামা প্রভৃতি পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, সুদান ও মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রফতানি করা হয়েছে। আলোচ্য পণ্যচালানগুলোতে রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ৮০ লাখ ৫১ হাজার ৬৪০ মার্কিন ডলার বা ৬৮ কোটি ৩৫ লাখ ৮৪ হাজার ২৩৬ টাকা প্রায়।

এম.ডি.এস ফ্যাশন ২০২০ সালে ১৮২টি রফতানি চালানে জালিয়াতি করেছে। রফতানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে এক হাজার ৩৭৬ মেট্রিক টন টি-শাট ছিল। আলোচ্য পণ্যচালানগুলোতে রফতানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ৫১ লাখ ৮২ হাজার ৫৮৬ মার্কিন ডলার বা ৪৪ কোটি টাকা প্রায়।

হংকং ফ্যাশনস লিমিটেড ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে ১৫৬টি রফতানি চালানে জালিয়াতি করেছে। রফতানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে এক হাজার ১৬১ মেট্রিক টন টি-শাট রফতানি করেছে। আলোচ্য পণ্যচালানগুলোতে রফতানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ৪৭ লাখ ৮৯ হাজার ৬০৬ মার্কিন ডলার বা ৪০ কোটি ৬৬ লাখ ৩৭ হাজার ৫৮৬ টাকা প্রায়।

থ্রি-স্টার ট্রেডিং ২০২০ সালে ১২০টি রফতানি চালানে জালিয়াতি করেছে। রফতানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ৮১৬ মেট্রিক টন টি-শার্ট রফতানি করেছে। রফতানিকৃত পণ্যের মূল্য ৩০ লাখ ৫৩ হাজার ১০৮ মার্কিন ডলার বা ২৫ কোটি ৯২ লাখ ৮ হাজার ৮৬৯ টাকা প্রায়।

ফরচুন ফ্যাশন ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে ৫৯টি রফতানি চালানে জালিয়াতি করেছে। রফতানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ৪৩৫ মেট্রিক টন টি-শার্ট রফতানি করেছে। আলোচ্য পণ্যচালানগুলোতে রফতানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় ১৫ লাখ ২৪ হাজার ৮১৩ মার্কিন ডলার বা ১২ কোটি ৯৪ লাখ ৫৬ হাজার ৬২৩ টাকা প্রায়।

অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড ২০২০ সালে ৪২টি রফতানি চালানের মাধ্যমে অর্থপাচার করেছে। রফতানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ১৯৫ মেট্রিক টন টি-শার্ট রপ্তানি করেছে। আলোচ্য পণ্যচালানগুলোতে রফতানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় আট লাখ ৭৭ হাজার ৪৭০ মার্কিন ডলার বা সাত কোটি ৪৪ লাখ ৯৭ হাজার ২০৩ টাকা প্রায়।

পিক্সি নিট ওয়্যারস লিমিটেড ২০২০ সালে ২০টি রফতানি চালানে জালিয়াতি করেছে। রফতানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ১৭০ মেট্রিক টন টি-শার্ট রফতানি করেছে। আলোচ্য পণ্যচালানগুলোতে রফতানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় পাঁচ লাখ ৯৬ হাজার ২৮২ মার্কিন ডলার বা পাঁচ কোটি ৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৪১ টাকা প্রায়।

স্টাইলাইজ বিডি লিমিটেড ২০২০ সালে ১০টি রফতানি চালানে জালিয়াতি করেছে। রফতানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ৬৬ দশমিক আট মেট্রিক টন টি-শার্ট রফতানি করেছে। এসব পণ্যের মূল্য প্রায় দুই লাখ ৫৫ হাজার ৬২৯ মার্কিন ডলার বা দুই কোটি ১৭ লাখ টাকা।

ইডেন স্টাইল টেক্স ২০২০ সালে আটটি রফতানি চালানে জালিয়াতি করেছে। রফতানিকৃত পণ্যচালানগুলোতে ৪২ মেট্রিক টন টি-শার্ট রফতানি করেছে। যার রফতানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রায় এক লাখ ৯৪ হাজার ৮৫ মার্কিন ডলার বা এক কোটি ৬৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮১৬ টাকা প্রায়।

কাস্টমস গোয়েন্দা জানায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রফতানিকৃত পণ্য হলো টি-শার্ট এবং প্রতি পিসের ওজন দেখানো হয়েছে ৫০০/৮০০/১০০০ গ্রাম বা তারও বেশি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতি কেজি নিট ফেব্রিক্স দিয়ে কমপক্ষে তিন থেকে ছয়টি লং স্লিভ টি এল সাইজ টি-শার্ট হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় প্রতিটি টি-শার্টের গড় ওজন ন্যূনতম ২৫০ গ্রাম ধরে রফতানিকৃত টি শার্টের সংখ্যা হিসাব করা হয়েছে।

এ ছাড়া কিছু কিছু পণ্যচালানে রফতানি পণ্যের মূল্য খুবই কম ঘোষণা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সমসাময়িক রফতানি চালানের সমজাতীয় পণ্যের মূল্য বিবেচনায় নিয়ে সম্ভাব্য রফতানিমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বিল অব এক্সপোর্টে অন্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি ব্যবহার করেছে।

আরও জানা যায়, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো পারস্পরিক সহযোগিতা ও যোগসাজশে জাল-জালিয়াতির এ ঘটনা ঘটেছে।

আপন দেশ/আরএ

মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়