সীতাকুণ্ডের একটি শিপ ব্রেকিংইয়ার্ডে ঝঁকিপূর্ণ অবস্থায় শ্রমিকরা -ফাইল ছবি
ঢাকা: ইউরোপীয় মেরিটাইম কোম্পানিগুলো তাদের পুরোনো জাহাজ ভাঙার জন্য বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। বাতিল এই জাহাজগুলো বিপজ্জনক ও দূষিত অবস্থায় থাকে। ফলে সেগুলো ভাঙার কাজে জড়িত শ্রমিকদের অনেকেই মৃত্যুর মুখে পড়ছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক এই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানটির সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সীতাকুণ্ড উপজেলার সমুদ্রসৈকত বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজভাঙা ইয়ার্ডগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান নির্মাণশিল্পের জন্য ইস্পাতের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে। এসব ইস্পাত সুলভে জোগানোর উৎস হয়ে উঠেছে পরিত্যক্ত জাহাজগুলো।
২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশে পাঠানো ৫২০টি পরিত্যক্ত জাহাজের মধ্যে ইউরোপের প্রতিষ্ঠানগুলোর জাহাজও রয়েছে। এসব জাহাজ ভেঙে আয়রোজগার করে থাকেন হাজার হাজার শ্রমিক। তবে জাহাজে থাকা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এড়াতে তারা সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহারের সুযোগ পান না।
বেলজিয়ামভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের’ সঙ্গে যৌথভাবে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এইচআরডব্লিউ।
এইচআরডব্লিউর গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) বলেছেন, কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বিপজ্জনক ও দূষণকারী ইয়ার্ডে জাহাজগুলো ভাঙছে। বাংলাদেশিদের জীবন ও পরিবেশের বিনিময়ে তারা লাভ করছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
তিনি বলেন, শিপিং কোম্পানিগুলোকে আন্তর্জাতিক আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার বন্ধ করা উচিত। তাছাড়া নিরাপদে ও দায়িত্বশীলভাবে সেখানের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেয়া উচিত।
শ্রমিকরা এইচআরডব্লিউকে জানিয়েছে, ইস্পাত কাটার সময় পোড়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে তারা মোজা গ্লাভস হিসেবে ব্যবহার করে। বিষাক্ত ধোঁয়া এড়াতে শার্ট দিয়ে মুখ ঢাকে ও খালি পায়ে স্টিলের টুকরো বহন করে।
যৌথভাবে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে এইচআরডব্লিউ জানায়, যখন আগুন লাগে বা পাইপে বিস্ফোরণ হয় তখন শ্রমিকরা আহত হয়। বিশেষ করে যখন ইস্পাতের টুকরো ভেঙে পড়ে।
বাংলাদেশি পরিবেশবাদী গ্রুপ ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন জানিয়েছে, ২০১৯ সাল থেকে সীতাকুণ্ডের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় অন্তত ৬২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন।
আর বার্তা সংস্থা এএফপিকে পুলিশ জানিয়েছে, গত সপ্তাহেই জাহাজ ভাঙার সময় পড়ে গিয়ে আলাদা দুই ঘটনায় দুজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
বাংলাদেশে জাহাজভাঙা ইয়ার্ডগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকারস অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিএ) জানিয়েছে, নিরাপদে ও পরিবেশের সুরক্ষার কথা বিবেচনায় রেখে জাহাজ ভাঙার একটি আন্তর্জাতিক নীতিমালা ২০২৫ সাল থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে। ওই নীতিমালার কথা মাথায় রেখে বিএসবিএর সদস্যরা নিরাপত্তাব্যবস্থা হালনাগাদকরণের পথে হাঁটছে।
বিএসবিএর সভাপতি মোহাম্মদ আবু তাহের বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও আমাদের জাহাজভাঙা ইয়ার্ডগুলো পরিবেশবান্ধব করার দিকে এগোচ্ছি। আমরা এ নিয়ে কাজ করছি। আমরা শ্রমিকদের বিভিন্ন সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করি।’
তবে ডেনমার্কের অর্থায়নে চলা ‘অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি ইনফরমেশন সেন্টারের’ সমন্বয়ক ফজলুল কবির মিন্টু বলেন, জাহাজভাঙা ইয়ার্ডগুলোর মালিকদের স্থানীয় রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এ কারণে অরক্ষিত অবস্থায় শ্রমিকেরা হতাহত হলেও তারা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন।
এএফপিকে তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি ইয়ার্ডে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে সামান্য বা কোনো গুরুত্ব দেয়া হয় না।
সীতাকুণ্ডের পরিত্যক্ত জাহাজের মধ্যে অনেকগুলোতে অ্যাসবেসটস থাকে বলে জানিয়েছেন জাহাজভাঙা শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা দাতব্য প্রতিষ্ঠান ওএসএইচই ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রিপন চৌধুরী। এই অ্যাসবেসটসের কারণে ক্যানসারসহ বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ হতে পারে।
তিনি বলেন, অ্যাসবেসটস নিয়ে শ্রমিকদের খালি হাতে কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
জাহাজ ভাঙার সময় বিষাক্ত অ্যাসবেসটসের সংস্পর্শে আসা ১১০ জন শ্রমিকের ওপর গবেষণা চালিয়েছিল ওএসএইচই ফাউন্ডেশন। ওই শ্রমিকদের মধ্যে ৩৩ জনের শরীরে পদার্থটির উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
রিপন চৌধুরী বলেন, ওই ৩৩ জনের সবার ফুসফুস বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন মারা গেছেন। বাকিরা দুর্দশায় জীবন কাটাচ্ছেন। সূত্র: আল জাজিরা
আপন দেশ/এমএমজেড
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।