ফাইল ছবি
স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭১-এর শিশুটি আজ যৌবন পেরোচ্ছে। এর মাঝে অনেক কিছুই ঘটেছে এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে, যাতে ভালো-মন্দ দুটিই আছে। জাতি স্বাধীনতার প্রকৃত গান কিছুটা হলেও গাইতে পারছে। নানা বিতর্ক নিয়েও যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে, হচ্ছে। এটিই আশার কথা। আরও আশার কথা, এখনকার প্রজন্ম উত্তরসূরিদের সৃষ্ট নানা ধোঁয়াশার পরিবেশ থেকেও প্রকৃত সত্য খুঁজছে।
বিজয়ের এত বছর পেরিয়ে এসে মুখ্য ভূমিকা পালনকারীরা অন্য এক দেশ চেয়েছিলেন। এ থাকবেই। এ বাস্তবতা। চাওয়া-পাওয়া মিলবে না। তাই তো তারা অভিমানে হলেও সুখ খোঁজেন। এ খোঁজাখুঁজি চলবেই। এরই মাঝে চলবে সময়। এ সময়ের ফেরে এখন আমরা বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে। এ ডিসেম্বরে অন্যরকম ফেরি চলে সারা বাংলায়। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়। এ ফেরিওয়ালারাও বর্তমান উত্তরসূরিদের রেখে যাওয়া খেদ নিয়ে সংসার চালাতে একখণ্ড লাল-সবুজ ভালোবাসা ফেরি করে বেড়ান। তাতে আর্থিক লাভ আছে। অবশ্য শুধুই লাভ থেকে তারা এটা করেন না। এর মাঝে একখণ্ড কাপড়ের প্রতি ভালোবাসাও জড়িত। এ থেকেই তাদের এ ফেরির সুখ! তাদেরও অন্য বাংলা দেখতে ইচ্ছে হয়। এ ইচ্ছার অংশ এমনতর ফেরিওয়ালা বেশ।
রাজধানীর কতক ফেরিওয়ালার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাদের কাছে রাখা হয় কিছু নির্দিষ্ট প্রশ্ন। প্রায় সবাই কাছাকাছি স্বপ্নের কথা জানান। জানান এ বাংলাকে কেমন দেখতে চান তারা। অন্যকিছুর ফেরি না করে কেন জাতীয় পতাকা ফেরি করছেন এমন প্রশ্নে তারা মুক্তিযুদ্ধের ঋণ শোধের কথা জানান। জানান স্বপ্নের কথা। তারা চান বাংলায়; আরও বাড়িয়ে পুরো বিশ্বে পতপত করে উড়ুক লাল-সবুজ পতাকা, এক টুকরো ভালোবাসা। তারাও জানেন এ চাওয়া ও পাওয়ায় রয়েছে বিস্তর ফারাক। প্রায় সবাই জানান, সব খেদ ভুলে যান যখন কেউ তাদের কাছ থেকে কেনা পতাকা হাতে নিয়ে আপ্লুত হয়ে যান।
প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই শুরু হয় পতাকা বিক্রির ধুম আয়োজন। চলে বিজয় দিবস পর্যন্ত। পতাকার ফেরিওয়ালারা রাজধানীতে বিজয় দিবসের আগমনী বার্তা বহনের বড় একটি ভূমিকা পালন করেন। এটি একটি মৌসুমী ব্যবসা। আরও এগিয়ে মাসখানেকের ব্যবসা। আর তা করতে দূর থেকেও কেউ কেউ ছুটে আসেন রাজধানীতে।
নরসিংদীর গুড়াশালের বাসিন্দা আকরাম হোসেন এমনই একজন। চার বছর ধরে প্রতিবছর এই সময়ে ঢাকা শহরে আসেন পেশায় কৃষিজীবী আকরাম। সদরঘাটের মহাজনের কাছ থেকে পতাকা নিয়ে বিক্রি করেন। এ মাসের ২ তারিখে এসেছেন। এবার তিন হাজার টাকার পতাকা নিয়েছেন। তার কাছে নানা আকারের পতাকা। সবচেয়ে বড় আকারের পতাকাটি তার কেনা ৯০ টাকায়। আর ছোটটি কেনা ১০ টাকায়। সব মাপের পতাকাতেই দ্বিগুণ লাভ। বড় পতাকা বিক্রি করেন ২০০, ছোটটি ১৫ টাকায়। ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেড় হাজার টাকার পতাকা বিক্রি করেছেন। শুরু করেন সদরঘাট থেকে, হেঁটে হেঁটে পতাকা বিক্রি শেষ হয় মিরপুরে গিয়ে। বিজয় দিবসের পরদিন ফিরে যাবেন নিজের গ্রামে। তবে আকরামের কাছে এ শুধু ব্যবসা নয়। তার ভাষায়, ‘দ্যাশের ভালোর জন্য একটা কাজ করতাছি, একটু সুখ পায় এ কাজে। শত হলেও মাইনষের আবেগ এতে মিশে আছে।’ তিনি জানান, এখন ফেরিওয়ালার সংখ্যা বেড়ে গেছে। লাভ তেমন হয় না। তারপরও এই সময়টা আসলে মনটা কেমন করে, তাই চলে আসেন ঢাকায়।
একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মরত রেজাউল আমিন আদরের ভাগ্নের জন্য ছোট আকারের তিনটি পতাকা কিনেন কারওয়ান বাজার থেকে। প্রতিবছর এ সময় তার ভাগ্নের পতাকা চাই-ই চাই। তিনি জানান, এ পতাকা শুধুই একখণ্ড কাপড় নয়। এটি একটি পরিবারকে বিজয়ের দিনে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর পড়ন্ত বিকেলে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে কথা হয় বিজয়ের ফেরিওয়ালা হাফিজুল ইসলামের সঙ্গে। কাঁধে অসংখ্য পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে হাফিজুল জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রামরাইলে ছোট একটি কাপড়ের দোকান আছে তার। কাপড় বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার মোটামুটি চলে যায়। তবু বিজয়ের মাস এলে দোকানের দায়িত্ব ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়ে ঢাকায় পতাকা ফেরি করতে আসেন তিনি। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পতাকা কিনতে বলেন সবাইকে। দিন শেষে একটি পতাকা বিক্রি না হলেও মনে আনন্দের কমতি থাকে না তার। লাভ হোক আর না হোক, সবার মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে পতাকা ফেরি করে বেড়ান হাফিজুল। তিনি বলেন, আমার কাছে কাঠি পতাকা, বেল্ট পতাকা ও কাপড়ের পতাকাসহ সব ধরনের পতাকা আছে। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী তা বিক্রি করি।
মিরপুরে পতাকা বিক্রি করছিল কিশোর মোহন। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর। বাবা কৃষক। দু-তিন বিঘা ফসলের জমি আছে তাদের। ডিসেম্বর এলে সখ করেই ঢাকায় পতাকা বিক্রি করতে আসে সে।
মোহনের ভাষায়, পতাকা বিক্রি করি শুধু ভালোলাগা থেকে। মানুষ যখন বাংলাদেশের পতাকা কিনে মাথায় বাঁধে তখন আরও বেশি ভালো লাগে। বিজয়ের স্বাদ পাই। নিজেকে স্বাধীন মনে হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে কথা হয় রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি সারা বছরই পতাকা বিক্রি, ব্যানার লিখন ও ব্যানারে রঙ করি। এটি করেই আমার সংসার চলে। এর মধ্যে পতাকার ব্যবসাটা আমার বেশি ভালো লাগে। কারণ হিসেবে তিনি জানান, এর মাঝে দেশের ও মানুষের ভালোবাসা জড়িত। তিনি জানান, সারা বছর পতাকা বিক্রি হয়। তবে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও একুশে ফেব্রুয়ারিসহ বিভিন্ন দিবসগুলোতে পতাকা বিক্রি বেড়ে যায়। এ সময় আমাদের ব্যস্তও থাকতে হয় অনেক বেশি।
যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার মোড়ে পতাকা কিনতে আসা সোহেলী আহমেদ বলেন, এ মাস বিজয়ের মাস। আমরা লাল সবুজ পতাকার জন্য যুদ্ধ করেছি। বিজয়ের সঙ্গে পতাকা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই পতাকা কিনতে এসেছি। তিনি বলেন, আমি আজ অনেক পতাকা কিনব। বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে নিজের ঘর সাজাব।
বিজয়ের মাস এলে দেশপ্রেমিক জনতা বসত বাড়ি, হাট-বাজার, দোকান-খামার, খেলার মাঠ ও সাংস্কৃতিক মঞ্চ সাজায় লাল-সবুজের পতাকা দিয়ে।
আরও পড়ুন <> বিজয়ের দিন আজ, গৌরবময় দিন
এদিকে বিজয়ের এমন ক্ষণে পতাকা বিক্রি ও উড়ানোর প্রবণতাকে সাধুবাদ দিয়ে সাংবাদিক ও গীতিকার এন আই বুলবুল বলেন, এ অবশ্যই সুখের। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে পতাকা যেন সুনির্দিষ্ট মাপে বানানো হয় এবং নিয়ম মেনে উড়ানো হয়।
বিজয়ের মাসে পতকা বিক্রি ও উড়ানোর এ প্রবণতাকে একটু অন্যভাবে দেখেন কবি ও সাংবাদিক মাহতাব শফি। তিনি বলেন, পতাকা উড়িয়ে অথবা ফেসবুকে ছবিকে পতাকার আকার দিয়ে দেশপ্রেম হয় না। দেশপ্রেম সম্পূর্ণ হূদয়ের ব্যাপার। সেটিকে মনে লালন করতে হয়। পতাকা উড়িয়ে ভালোবাসা হয় না। পতাকার মর্যাদাও রাখতে হয়।
জাতীয় পতাকা বিক্রি ও উড়ানোর প্রবণতাকে শ্রমিক নেতা মোশরেফা মিশু এভাবে ব্যাখ্যা করেন, মানুষ তাদের আবেগের জায়গা থেকে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করে থাকেন। মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালন করছে না। জাতীয় পতাকার যথেচ্ছ ব্যবহারের দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। রাষ্ট্র ও সরকারের ব্যর্থতার কারণেই জাতীয় পতাকার অবমাননা হয়ে চলছে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ পতাকা বিক্রির এই প্রবণতাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেন। তিনি জানান, বছরের একটি-দুটি দিন নানা পেশা, বয়সের মানুষ পতাকা নিয়ে ঘোরে- এটি আনন্দের। তিনি বলেন, জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিনে রাজনৈতিক নেতারা তোরণ, পোস্টার, বিলবোর্ডে আত্মপ্রচারে ব্যস্ত থাকেন। এর থেকে অনেক ভালো পতাকার এই স্বতঃস্ফূর্ততা।
বিজয়ের এ ফেরিওয়ালাদের চাওয়া অন্য বাংলায় পতপত করবে তাদের সরবরাহ করা পতাকা। তাদের অনেকেই জানেন না পতাকার আকার ও উড়ানোর সুনির্দিষ্ট নিয়ম। এই প্রতিবেদকের মাধ্যমে তা জেনে ভবিষ্যতে তা পালনের অঙ্গীকার করেন।
এদিকে আপামর মানুষ চায় তাদের মতো অঙ্গীকার। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাকে গড়ার। এ খুব বেশি চাওয়া নয়।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।