ফাইল ছবি
বিদায় ২০২৩। আরেকটি খ্রিস্টীয় বছরের সমাপ্তি। আজ রোববার (৩১ ডিসেম্বর) সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে শুরু হবে নতুন বছর ২০২৪। সময়ের পরিক্রমায় মধ্যরাত হতেই মহাকালে হারিয়ে যাবে আরেকটি বছর।
ঝরা পল্লবের মতো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে খসে পড়বে ২০২৩। ফেলে আসা বছরটি এখন ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’। নববর্ষকে আহ্বান জানিয়ে ফুরাবে এ বছরের সব লেনদেন। বিদায় অভাবনীয় আলোড়ন সৃষ্টিকারী ২০২৩। দুঃখ-বেদনা ভুলে নতুন আশায় স্বাগত ২০২৪।
সব বিদায়েই থাকে আনন্দ-বেদনার কাব্য। ২০২৩ সালকে বিদায়ের মুহূর্তেও ‘না পাওয়ার বেদনা’ মনকে ভারাক্রান্ত করে। তবে আগামীতে সব অনিশ্চয়তা কেটে যাওয়ার আশায় বুক বাঁধে মানুষ। নেতিবাচক বিষয়গুলো দূরে ঠেলে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশা করেন সবাই।
আমাদের অধিকাংশ কর্মকাণ্ডই চলে ইংরেজি সাল গণনায়। তাই খ্রিস্টীয় বছর আমাদের জীবনে অনেক গুরুত্ববহ।
অবশ্যই যার যার অভিজ্ঞতা ও ভাবনা থেকে মূল্যায়িত হবে ২০২৩। তবে আমাদের জাতীয় জীবনে বিদায়ী বছরটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২০২৩ ছিল ঘটনাবহুল। নানা চ্যালেঞ্জ এসেছে, উত্থান-পতনের ঘটনাও ঘটেছে। সবকিছু পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।
বিদায়ী বছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট অর্থনীতিকে বেশ চাপে ফেলে। জুনের পর মূল্যস্ফীতি দ্রুত বাড়তে থাকে। ডলার সংকট ও টাকার বিনিময় মূল্যে পতন মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দেয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংক কড়াকড়ি আরোপ করে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে।
রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় বছর শেষে জাতীয় নির্বাচনের রথে শাসক দল আওয়ামী লীগ। বিএনপি ও সমমনা জোটের অবরোধ-হরতালে নাশকতা, বিশেষ করে ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২০২৩ সালে।
গত ২০ ডিসেম্বর সিলেটে মাজার জিয়ারত ও জনসভার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২৭ ডিসেম্বর ঘোষিত দলীয় ইশতেহারে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন তিনি।
অন্যদিকে, বিদায়ী বছরজুড়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করে বিএনপি। বাধা অতিক্রম করে সমাবেশ ও পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করে। গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, এলডিপিসহ প্রায় ৩৭টি দল একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করে। ঘোষণা করে রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা ‘রূপরেখা’ ও ১০ দফা দাবি।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ করে বিএনপি। তবে নাশকতা ও সংঘর্ষের জেরে শুরুতেই তা পণ্ড হয়। ডিসেম্বরের শেষ প্রান্তে এসে ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জনসহ সরকারের বিরুদ্ধে ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে দলটি।
বিদায়ী বছরে ছিল কূটনীতিকদের ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ। জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কিছু দেশ নিজের আগ্রহে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে। তারা বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানান। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ছিল আলোচনার অন্যতম বিষয়।
২০২৩ সালে চালু হয়েছে পদ্মা রেল সংযোগ, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ, আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েলগেজ রেলপথ, খুলনা-মোংলা রেলপথ ও উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল।
বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল। চীনের ঋণে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ চলছে। এই রেলপথ গেছে পদ্মা সেতু হয়ে। গত ১০ অক্টোবর পদ্মা রেল সংযোগের ৮৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা অংশ উদ্বোধন করেন সরকারপ্রধান। যাত্রীবাহী ট্রেন চলছে গত ১ ডিসেম্বর থেকে।
আরও পড়ুন <> মধ্যরাতে বিশ্বের জনসংখ্যা ৮০০ কোটি ছাড়াবে
গত জানুয়ারি থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের তিন শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পড়ানো হয়। চালুর কিছুদিনের মধ্যে এই শিক্ষাক্রম নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে রাস্তায় কর্মসূচি পালন হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে কথা চলছে।
২০২৩ সালের আরেকটি আলোচিত বিষয় ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব। সরকার ঘোষণা না দিলেও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এডিস মশাবাহিত এ রোগকে ‘মহামারি’ আখ্যা দেন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। গতকাল শনিবার পর্যন্ত ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে দেশে মৃত্যু হয় এক হাজার ৭০৩ জনের এবং আক্রান্ত হন তিন লাখ ২১ হাজার ৩৭ জন।
বিদায়ী বছরে রাজধানীতে বেশ কয়েকটি গ্যাস দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে। গত ৭ মার্চ বিকেলে হঠাৎ বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে রাজধানীর পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজার এলাকার ‘ক্যাফে কুইন’ ভবন। বিস্ফোরণে বহুতল ভবনটির দোতলা পর্যন্ত ধসে পড়ে। এতে ২৫ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও শতাধিক মানুষ। এর দু’দিন আগে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় আরেক ভবনে বিস্ফোরণে ছয়জনের প্রাণ যায়। সংশ্লিষ্টরা বলেন, পাইপের লিকেজ (ছিদ্র) থেকে বের হওয়া গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণ ঘটে।
প্রায় পাঁচ বছর দু-একটি ঘটনা ছাড়া দেশের শ্রম খাত মোটামুটি শান্তই ছিল। তবে বিদায়ী বছরের শেষ দিকে পোশাকশিল্পে নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা নিয়ে ব্যাপক শ্রম অসন্তোষ দেখা দেয়। গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার ও রাজধানীর মিরপুরে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা হামলা-ভাঙচুরে জড়িয়ে পড়েন। পাল্টা ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও মারমুখী হয়। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান তিন শ্রমিক। কারখানায় দেয়া আগুনের ধোঁয়ায় আটকা পড়া আরও এক শ্রমিক মারা যান।
এত কিছুর পরেও জীবনযাত্রা থেমে নেই। এখন জড়তা, ভয়কে পাশে ঠেলে আবার জাগছে মানুষ নতুন স্বাভাবিকতায়। সব বিদায়ের সঙ্গেই লুকিয়ে থাকে কিছু আনন্দ-বেদনার কাব্য, আশা আর অপরিমেয় প্রত্যাশা।
নানা আয়োজনে আজ খ্রিস্টীয় ২০২৩ সাল বিদায় এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানাবে দেশের মানুষ।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।