ছবি : সংগৃহীত
হাড় কাঁপানো শীতে জবুথবু সারা দেশ। বিপর্যস্ত জনজীবন। ধুঁকছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। শিশু ও বৃদ্ধরা রোগাক্রান্ত হচ্ছেন। এর মাঝেই যারা ভাবছেন শীতের তীব্রতা সামনে কমে আসবে, তাদের জন্য দুঃসংবাদ। এই জানুয়ারি মাসের বাকি অর্ধেকটা সময় শীতের তীব্রতা খুব বেশি কমে আসার সম্ভাবনা তেমন নেই।
রাজধানী ঢাকায় দিনে দেড়–দুই ঘণ্টার বেশি রোদ থাকছে না। গত কিছুদিন ধরে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অন্যদিকে দেশের উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকায় সারা দিনে একবারও ঠিকমতো সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। তিন দিন ধরে পরিস্থিতি এমন, যেন ঘন কুয়াশার চাদর ঘিরে রেখেছে আশপাশ। শীতের কষ্ট থেকে রক্ষা পেতে উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকার মানুষ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সন্ধ্যার পর বাইরে কমই বের হচ্ছেন।
আজ সোমবার মাঘ মাসের প্রথম দিন। প্রকৃতিতে শীতের দাপট নিয়েই এলো মাঘ। শীত ঋতুর সমাপ্তি এ মাসেই। এদিকে কোথাও কোথাও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো কুয়াশা ঝরছে। সাধারণত জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত শীতের দাপট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে থাকে।
রোববার (১৪ জানুয়ারি) দেশের ২৩টি জেলায় তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামে। আবহাওয়া বিশ্লেষকেরা বলছেন, আজ সোমবারও বাড়তে পারে হাড় কাঁপানো শীতের তীব্রতা।
আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, দমকা হাওয়া বা বৃষ্টি না নামলে ঘন কুয়াশা সরবে না। আর কুয়াশা না সরলে রোদ এসে শীতের দাপট কমাতে পারবে না। আগামী বৃহস্পতিবার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে আকাশে মেঘ জমতে পারে। অনেক জায়গায় শুরু হতে পারে বৃষ্টি। বৃষ্টি চলতে পারে দু–তিন দিন। এরপর শীতের তীব্রতা কিছুটা কমতে পারে। তবে বৃষ্টি চলে যাওয়ার পর দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কিছুটা বাড়বে। তখন দিনে শীতের অনুভূতি কিছুটা কমে আসবে। তবে রাতে শীতের তীব্রতা এখনকার মতোই থাকতে পারে।
আবহাওয়াবিদেরা সারা দেশে কুয়াশার দাপট বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে গত ডিসেম্বর মাসজুড়ে থাকা বাড়তি তাপমাত্রাকে দায়ী করছেন। ডিসেম্বর মাসে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে দুই দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি ছিল। জানুয়ারিতে এসে তাপমাত্রা হঠাৎ চার–পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে গেছে। হঠাৎ তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় প্রচুর কুয়াশা তৈরি হয়েছে। কুয়াশার কারণে সূর্যের আলো ভূমিতে কম আসতে পারায় শীতের অনুভূতি বেশি হচ্ছে। গত তিন–চার দিনে দেশের অনেক এলাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা আট থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমে যায়।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের চার জেলা—রাজশাহী, পঞ্চগড়, চুয়াডাঙ্গা ও দিনাজপুরে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। রোববার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল দিনাজপুরে—আট দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১৮ দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এদিন রাজধানীতে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য ছিল চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। যে কারণে রাজধানীতে শৈত্যপ্রবাহ না থাকা সত্ত্বেও শীতের অনুভূতি ছিল বেশি।
তীব্র শীতে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের। একই সঙ্গে ঠাণ্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
আমাদের প্রতিনিধিরা জানান, কুয়াশা ও ঠাণ্ডা বাতাসের কারণে দিনের বেলায়ও দেশের উত্তর–দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের অনেক এলাকায় জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে।
খুলনায় রিকশাচালক আলাউদ্দিন গাজী (৪৫) বলেন, রাস্তায় যাত্রী কম। যে কারণে আমার আয়ও কম। এমন ঠাণ্ডা অনেক দিন পড়েনি।
উত্তরের জেলা দিনাজপুর ও নীলফামারীতেও তীব্র শীতে জনজীবনে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এই দুই জেলার গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন বাড়ির উঠানে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুনের তাপ নেয়ার দৃশ্য এখন সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে। গ্রামের টিনের ঘরের চালে রাতে কুয়াশা যেন বৃষ্টির মতো ঝরে।
আরও পড়ুন <> শীতে জবুথবু দেশ, সূর্যের দেখা নেই
নীলফামারীর রামনগর এলাকার দিনমজুর আব্দুল খালেক বলেন, তীব্র ঠাণ্ডায় কাজে যেতে পারছি না। অভাবের সংসার, কাজে যেতে না পারায় খুব সমস্যায় আছি।
একই জেলার রিকশা চালক শহিদুল ইসলাম বলেন, কয়েকদিন ধরে রোদ ওঠে না। ঠাণ্ডার কারণে রাস্তায় মানুষের চলাচল কমে গেছে। বাড়িতে বসে থাকলে পেটে খাবার জুটবে না। বাধ্য হয়ে প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও রাস্তায় বেরিয়েছি।
ডোমার উপজেলার বড়রাউতা এলাকার কৃষক আলতাফ হোসেন বলেন, প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে শীতের প্রকোপটা বেশি। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কাজ করতে খুব সমস্যা হচ্ছে। শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। যারা পেটের দায়ে কাজে আসছেন তারাও শীতের মধ্যে টিকতে পারছেন না।
নীলফামারী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক এস এম আবু বকর সাইফুল ইসলাম বলেন, ফসলের বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখার পাশাপাশি পানি ঢালার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে কৃষকদের।
ঘন কুয়াশার কারণে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রোববার দুটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট নামতে পারেনি। সেগুলো পরে কলকাতায় চলে গেছে। তবে বেলা বেড়ে যাওয়ার পরপর বিমান ওঠানামা স্বাভাবিক অবস্থায় চলে এসেছে।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, এই সময়ে সাধারণত তীব্র শীত থাকলেও দিন এবং রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য আট থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। এ কারণে দিনে অন্তত শীতের তীব্রতা কম থাকে। কিন্তু গত চার দিন দেশের বেশির ভাগ এলাকায় রাত ও দিনের তাপমাত্রার পার্থক্য পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম থাকছে। যে কারণে শীতের কষ্ট বেড়ে গেছে।
আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, তিন কারণে ঠাণ্ডার অনুভূতি বেড়েছে। দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে এসেছে। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাতাসের প্রবাহ বেড়েছে এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপরে ঘন কুয়াশার আস্তর তৈরি হওয়ায় সূর্যের কিরণ আসছে না; ফলে দিনের তাপমাত্রা বাড়ছে না।
আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, এমন শীতার্ত আবহাওয়া আরও চার-পাঁচ দিন থাকবে। আগামী বৃহস্পতি-শুক্রবার বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকায় এখন শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও বৃষ্টির পর শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তিনি।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।