ছবি : সংগৃহীত
তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশায় বিপর্যস্ত দেশ। তাপমাত্রা কমে শীত আরও বেড়েছে। এতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও আয়-রোজগার ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। কনকনে ঠাণ্ডায় প্রবীণ ও শিশুরা সবচেয়ে ভোগান্তিতে পড়ছেন। নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন ঠাণ্ডাজনিত রোগে ভুগছেন বৃদ্ধ ও শিশুরা। আবহাওয়া অফিস বলছে, জানুয়ারির বাকি দিনগুলোতেও কাঁপাবে শীত।
এদিকে শীত তাড়ানোর যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়েছে। রাজধানী ও দেশের বিভাগীয় শহরগুলো ছাড়াও জেলা পর্যায়ে ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকানগুলোতে ভিড় করছেন অনেকে। এসব যন্ত্রের বিক্রিও বেড়েছে।
অন্যদিকে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নামায় কয়েক জেলায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অনেক জেলায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।
দেশের ছয়টি বিভাগে আজ বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) থেকে বৃষ্টির পূর্বাভাস জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। বৃষ্টির পরিমাণ স্থানভেদে কমবেশি হতে পারে। তবে শনিবারের মধ্যে বৃষ্টির প্রবণতা কমে আসবে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বৃষ্টির কারণে শীতের অনুভূতিও অনেকটা কমে যাবে। তবে বৃষ্টি-পরবর্তী সময়ে আবারো শীতের অনুভূতি বাড়বে।
আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খুলনা ও বরিশালের অনেক জায়গায়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের দু-এক জায়গায় বৃষ্টি হতে পারে। পরের ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের স্থান কমে যাবে; বরিশাল ও চট্টগ্রামের দু-এক জায়গায় বৃষ্টি হতে পারে।
তবে বৃষ্টির কারণে দেশে শীতের অনুভূতি অনেকটাই কমে যাবে। দেশের বেশির ভাগ স্থানে দিনের বেলায়ও কুয়াশা দেখা যাচ্ছে। ফলে সূর্যের তাপও কমে আসছে। এতে দিন ও রাতের তাপমাত্রায় পার্থক্য কমে যাচ্ছে।
অন্যদিকে বাতাসের কারণে শীতের অনুভূতি বাড়ছে। অর্থাৎ যেখানে ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রয়েছে, সেখানে ১০ ডিগ্রির শীত অনুভূত হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসবে। বৃষ্টি শেষে দিনে সূর্যের তাপ পাওয়া যাবে। দিন ও রাতের তাপমাত্রায় ব্যবধান বাড়বে। সব মিলিয়ে শীতের অনুভূতি কমবে।
আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, গত মঙ্গলবার থেকে দেশের চারটি অঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহ বিরাজ করেছে। বৃষ্টিপাত শুরু হলে শৈত্যপ্রবাহ বন্ধ হতে পারে। তবে বৃষ্টিপাতের ধারাবাহিকতা শেষ হলে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত রাতের তাপমাত্রা আবারো কমতে পারে।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, বুধবার ছয়টি জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ছিল। জেলা ছয়টি হচ্ছে চুয়াডাঙ্গা, বরিশাল, বান্দরবান, মৌলভীবাজার (শ্রীমঙ্গল), পাবনা (ঈশ্বরদী) ও চট্টগ্রাম (সীতাকুণ্ড)।
এদিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে বান্দরবানে নয় দশমিক চার ডিগ্রি। এ ছাড়া ঈশ্বরদী, শ্রীমঙ্গল, সীতাকুণ্ড, চুয়াডাঙ্গা ও বরিশালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ ডিগ্রির নিচে। দেশের অন্যত্র সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি। এদিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে টেকনাফে ২৬ দশমিক নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়াবিদ শাহীনুল ইসলাম বলেন, এটি মৌসুমের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত।
অন্যদিকে একটু উষ্ণতার জন্য বিশেষ করে ঘরের শিশু আর বয়স্কদের কথা ভেবে অনেকেই শীত তাড়ানোর যন্ত্রপাতির খোঁজে ভিড় করছেন ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকানগুলোতে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, বেশ ভালো বিক্রি হচ্ছে গিজার, রুম হিটার, গরম বাতাসের ফ্যান, বৈদ্যুতিক জগ, ফ্লাক্স ইত্যাদি। ক্রেতারাও দরদাম করে পছন্দমত বেছে নিচ্ছেন এসব জিনিস।
মোহাম্মদপুরে গৃহিণী আলেয়া ইসলাম বলেন, বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা ও ছোট বাচ্চা আছে। গত কয়েকদিনের শীতে বারবার চুলায় গরম পানি করতে হয়েছে। এ ছাড়া রাতে শীতের তীব্রতায় ঘুমাতে পারেনি বাবা-মা। তাই হিটার ও বৈদ্যুতিক জগ কেনা জরুরি হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকানের বিক্রয় কর্মীরা বলছেন, শীতের শুরু থেকে মৌসুমি এসব যন্ত্রের বিক্রি এমনিতেই বেড়ে যায়। তবে গত কয়েকদিনের তীব্র শীতে এবার চাহিদা বেড়েছে আরও বেশি। স্বল্প ও মধ্যম আয়ের অনেক ক্রেতার দেখা মিলছে।
আরও পড়ুন <> দিনের তাপমাত্রা বেড়ে শীতের অনুভূতি কমেছে
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সারাদেশে রোগীদের তথ্যের রেকর্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শীতকালীন অসুস্থতা হিসেবে শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও ডায়রিয়া বড় আকারে দেখা দিয়েছে। গত ১৫ নভেম্বর থেকে ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব রোগে দুই লাখ ৩৩ হাজার ৩১৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬১ হাজার ৯২৪ জনের তীব্র শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এবং এক লাখ ৭১ হাজার ৩৯৪ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন।
শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শীতকালে স্বাভাবিকভাবেই ঠাণ্ডাজনিত মৌসুমি রোগব্যাধি বাড়ে। আমাদের হাসপাতালেও এ ধরনের রোগী আসছে। তবে হাসপাতালে পর্যাপ্ত শয্যা থাকায় রোগীদের ভালোভাবে চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে।
প্রয়োজনের বেশি উষ্ণতায় শিশুকে রাখা যাবে না জানিয়ে ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অনেক সময় দেখা যায় মা-বাবা শিশুকে অতিরিক্ত কেয়ার করতে গিয়ে বেশি উষ্ণতা দিয়ে ফেলছেন। এতে শিশুর শরীর থেকে যে ঘাম বের হয় সেটি তার স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ভালো নয়। এ ছাড়া সারাদিন দরজা-জানাল বন্ধ রাখা যাবে না। ঘরে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে দিতে হবে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া শিশুকে নিয়ে বাইরে যাওয়া যাবে না। এছাড়া শিশুর সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে।
এসময়ে স্কুল কিংবা মাদরাসা পড়ুয়া খুদে শিক্ষার্থীদের গায়ে বিভিন্ন ধরনের চুলকানি দেখা দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এগুলো ছোঁয়াচে হয়। শিশুরা একজন অন্যজনের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করে। তাই গায়ে চুলকানি দেখা দিলে শিশুকে অন্যদের থেকে আলাদা রাখতে হবে।
শিশু হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কামরুজ্জামান বলেন, শীতের সময় শিশুদের রোগবালাই বেশি দেখা দেয়। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুকে সুস্থ রাখতে বেশিরভাগ সময় মাথা ঢেকে রাখতে হবে। অহেতুক বাসার বাইরে বা মার্কেটে শিশুকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করা যাবে না। কাশি হলেই ফার্মেসি থেকে কিনে শিশুকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো যাবে না।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, শীত মৌসুমে শুধু হাসপাতালে নয়, শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারেও শীতজনিত রোগীর অনেক চাপ। শীত ও বায়ুদূষণজনিত রোগীর সংখ্যা বছরের অন্য সময়গুলোর চেয়ে এখন দু-তিন গুণ বেড়ে গেছে। শিশুদের অনেকে আসছে সর্দি, নাক বন্ধ হওয়া ও হাঁচি-কাশি নিয়ে। একটা অংশের তীব্র জ্বর, গলা ব্যথা ও কাশি।
তিনি বলেন, দেখা গেছে, এ ধরনের রোগীদের কোনো সংক্রমণ নেই, জ্বরও নেই। কিন্তু নাক বন্ধ থাকায় নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, নবজাতক হলে দুধ টেনে পান করতে পারে না। বাচ্চা ঘুমাতে পারে না, কান্নাকাটি করে। শীতের সময়ে বাচ্চারা শ্বাসতন্ত্রের নানা ধরনের সংক্রমণ এবং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এসময় বাচ্চাদের অ্যাজমাও বেড়ে যাচ্ছে। ধূলিকণা নিশ্বাসের সঙ্গে শ্বাসতন্ত্রে গিয়ে ছোট-বড় সবারই ক্রনিক কাশি হচ্ছে। শৈত্যপ্রবাহের সময় এসব সমস্যা বেশি হয়।
আপন দেশ/এমআর
মন্তব্য করুন ।। খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত,আপন দেশ ডটকম- এর দায়ভার নেবে না।